প্রথমে বসন্ত ঋতু নবীন পল্লব ।
দুই পক্ষ আগে পাছে মধ্যে সুমাধব ৷৷
মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি ।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি ৷৷
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল ৷
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল ৷৷
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
শুনিতে যুবক মনে জাগে অনুভব ৷৷
নানা পুষ্প মালা গলে বড় হরষিত ।
বিচিত্র বসন অঙ্গে চন্দন চৰ্চিত ৷৷
নিদাঘ সমএ অতি প্রচণ্ড তপন ।
রৌদ্র ত্রাসে রহে ছায়া চরণে সরণ ॥
চন্দন চম্পক মাল্য মলয়া পবন ।
সতত দম্পতি সঙ্গে ব্যাপিত মদন ৷৷
পাবন সময় ঘন ঘন গরজিত।
নির্ভয়ে বরিষে জল চৌদিকে পূরিত ৷৷
ঘোর শব্দে কৈলাসে মল্লার রাগ গাত্র ।
দাদুরী শিখীনি রব অতি মন ভাএ ॥
কীটকুল রব পুনি ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে ।
শুনিতে যুবক চিত্ত হরষিত ডরে ৷
আইল শারদ ঋতু নির্মল আকাশে ।
দোলাএ চামর কেশ কুসুম বিকাশে ৷
নবীন খঞ্জন দেখি বড়হি কৌতুক ।
উপজিত যামিনী দম্পতি মনে সুখ ৷
প্রবেশে হেমন্ত ঋতু শীত অতি যায় ।
পুষ্প তুল্য তাম্বুল অধিক সুখ হয় ৷৷
শীতের তরাসে রবি তুরিতে লুকাএ ।
অতি দীর্ঘ সুখ নিশি পলকে পোহাএ ॥
পুষ্প শয্যা ভেদ ভুলি বিচিত্র বসন ।
উরে উরে এক হৈলে শীত নিবারণ ৷৷
কাফুর কস্তুরী চুয়া যাবক সৌরভ।
দম্পতির চিত্তেত চেতন অনুভব ৷৷
আলাওল সতেরো শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে ফতেহাবাদ পরগনার (বর্তমান ফরিদপুর জেলা) জালালপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময়ে তাঁর পিতা ও তিনি পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়েন। এই আক্রমণে তাঁর পিতা নিহত হন। তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে আরাকানে উপস্থিত হন। সেখানে প্রথমে আরাকান রাজের সেনাদলে কাজ পান তিনি; ক্রমে রাজদরবারের প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুরের কৃপাদৃষ্টি লাভ করেন এবং রাজসভাসদভুক্ত হন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কাব্যপ্রতিভা ও বিদ্যাবুদ্ধির গুণে আলাওল ‘পদ্মাবতী' কাব্য রচনা করেন। রাজসভার শিক্ষিত ও পদস্থ ব্যক্তিদের সাহচর্যে থেকে তিনি কাব্যচর্চা করেছেন। তাঁর রচনায় নাগরিক চেতনা ও রুচির ছাপ সুস্পষ্ট। সংস্কৃত, আরবি, ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপন্ন আলাওল অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। শিল্পকুশলী এই কবির অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে— কাব্য : ‘সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল', ‘হপ্ত পয়কর', ‘সিকান্দরনামা'; নীতিকবিতা : ‘তোফা”; সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য : ‘রাগতালনামা' । আলাওল ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
সুমাধব - উত্তম বসন্তকাল; সুবন বসন্তকাল।
মলয়া সমীর - দখিনা স্নিগ্ধ বাতাস ।
কামের - কামদেব-এর। প্রেমের দেবতার । সংবাদ বাহক।
পদাতি - পদচারী সৈনিক।
কৈল - করিল ।
বনস্পতি - যে বৃক্ষে ফুল ধরে না শুধু ফল হয়। অশ্বত্থ, বট ইত্যাদি বৃক্ষ ।
কিংশুক - পলাশ ফুল বা বৃক্ষ
সুরঙ্গ - সুন্দর রঙ । শোভন বৰ্ণ ।
মল্লি - বেলিফুল। বেলফুল।
লবঙ্গ - একপ্রকার ফুল। মসলা ।
গুলাল - আবির। ফাগ।
ঝঙ্কার - বীণাযন্ত্রের শব্দ। গুঞ্জন ।
নিদাঘ - গ্রীষ্মকাল। উত্তাপ।
সরণ - শরণ অর্থে ব্যবহৃত । আশ্রয়।
বরিষে - বর্ষিত হচ্ছে। অজস্র ধারায় বৃষ্টিপাত ।
পূরিত - পূর্ণ। ভরা। ভরপুর ।
কৈলাস - শিবের বাসস্থান। হিমালয় পর্বতের একটি অংশ।
মল্লার - মালহার; সংগীতের একটি রাগ; রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে গাওয়া হয়।
দাদুরী - মাদি ব্যাঙ। ভেকী ।
শিখিনী - ময়ূরী ।
অতি মন ভাএ - মনে অনেক ভাব জাগে ।
পুনি - পুনরায় ।
চামর - পাখা বিশেষ। চমরী- গরুর পুচ্ছ দিয়ে তৈরি পাখা ।
খঞ্জন - এক জাতীয় চঞ্চল পাখি ।
উপজিত - উপস্থিত হয়। উৎপন্ন
তাম্বুল - পান। একপ্রকার পাতা যা সুপারি চুন ইত্যাদি সহযোগে খাওয়া হয় ।
তরাসে - ভয়ে। ত্রাসে।
তুরিতে - দ্রুত। শীঘ্র। তাড়াতাড়ি।
কাফুর - কর্পূর। শুভ্র গন্ধদ্রব্য বিশেষ ।
কস্তুরী - মৃগনাভি ৷
চুয়া - গন্ধদ্রব্য। একপ্রকার সুগন্ধি ঘন নির্যাস।
যাবক - আলতা ।
আলাওলের “ঋতু বর্ণন” কবিতাটি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মাবতী'র ঋতু বর্ণন খণ্ড থেকে সংক্ষেপিত আকারে
সংকলিত। প্রকৃতির বিচিত্র রূপ অভিব্যক্ত হয় আবহাওয়া ও ষড়ঋতুর প্রভাবে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে মানুষ হয়েছে মুগ্ধ। মুগ্ধ হয়েছেন সংবেদনশীল কবিগণও । ঋতু বর্ণনা মধ্যযুগের কাব্যের এক স্বাভাবিক রীতি।
কবি আলাওল এই ঋতু বর্ণনায় প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের সাথে মানব মনের সম্পর্ক ও প্রভাব তুলে ধরেছেন। বসন্তের নবীন পত্রপুষ্প, মলয় সমীর, ভ্রমর গুঞ্জন ও কোকিলের কুহুতান; গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তপনের রৌদ্র ত্রাস ও ছায়ার গুরুত্ব; বর্ষার মেঘ গর্জন, অবিরল বৃষ্টিজলে স্নাত প্রকৃতি, একটানা দাদুরী শিখীনি রব; শরতের নির্মল আকাশ, ফুলের চামর দোলা, খঞ্জনার নাচ; শরৎ বিদায়ে হেমন্তে পুষ্পতুল্য তাম্বুলের সুখ এবং শীতের ত্রাসে ত্বরিত সূর্য ডুবে যাওয়া, রজনীতে সুখী দম্পতির চিত্তসুখ ইত্যাদি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে কবিতাটিতে। ষড়ঋতুর বর্ণনার ভেতর দিয়ে কবি বাংলার প্রকৃতির রূপ-মাধুরী তুলে ধরেছেন। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য বাংলার নিসর্গ-রূপকে যে সমৃদ্ধ করেছে তা এ কাব্যাংশ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ।
পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুঃখবাণী ।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রে ছাউনি ॥
ভেরাণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে ।
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে ॥
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন ৷
খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ ॥
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস ।
বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস ॥
আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল ।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বল ॥
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদ-কুড়া মিলে উদর না পুরে ॥
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি ॥
অভাগ্য মনে গুণি অভাগ্য মনে গুণি ।
কত শত খায় জোঁক নাহি খায় ফণী ॥
ভাদ্রপদ মাসে বড় দুরন্ত বাদল ।
নদনদী এককার আটদিকে জল ॥
আশ্বিনে অম্বিকা পূজা করে জনে জনে।
ছাগল মহিষ মেষ দিয়া বলি দানে ॥
উত্তম বসনে বেশ করয়ে বনিতা।
অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা ॥
কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ ।
যগজনে করে শীত-নিবারণ বাস ॥
নিযুক্ত করিলা বিধি সভার কাপড় ।
অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড় ॥
মাস মধ্যে মাস্যর আপনে ভগবান ।
হাটে মাঠে গৃহে গোঠে সভাকার ধান ॥
উদয় পুরিয়া অন্ন দৈবে দিলা যদি।
যম-শম শীত তথি নিরমিলা বিধি ॥
পউষে প্রবল শীত সুখী যগজন ৷
তুলি পাড়ি পাছড়ি শীতের নিবারণ ॥
হরিণী বদলে পাইনু পুরাণ খোসলা ।
উড়িতে সকল অঙ্গে বরিষয়ে ধুলা ॥
মাঘে কুঞ্ঝটিকা প্রভু মৃগয়াতে যায় ।
আন্ধারে লুকায় মৃগ দেখিতে না পায় ॥
সহজে শীতল ঋতু ফাল্গুন যে মাসে।
পোড়ায় রমণীগণ বসন্ত বাতাসে ॥
অনল সমান পোড়ে চইতের খরা।
চালু সেরে বান্ধা দিনু মাটিয়া পাথরা ॥
দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান ।
আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান ॥
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (আনুমানিক ১৫৪০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর পিতা হৃদয় মিশ্র এবং মাতা দৈবকী। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে । সম্ভবত ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দরাম পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে আশ্রয় নেন এবং সেখানকার জমিদারপুত্রের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। পরে জমিদার রঘুনাথ রায়ের সভাকবিরূপে তাঁরই প্রেরণায় ‘চণ্ডীমঙ্গল' কাব্য রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য এ কবিকর্মের জন্য জমিদার তাঁকে ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মুকুন্দরামের পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল অসাধারণ। মঙ্গলকাব্যের প্রথাগত সীমার মধ্যে থেকেও তিনি এতে বাস্তব জীবনচিত্র উপস্থাপনে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কাব্যে সাধারণ বাঙালি জীবন, সমকালীন সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা, মানব চরিত্র চিত্রণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা অসামান্য রূপ লাভ করেছে। গণজীবনের করুণ চিত্র বিশ্বস্ততার সাথে অঙ্কনের জন্য তাঁকে দুঃখবাদী কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও তাঁর কাব্য মানবজীবনরসে পূর্ণ। স্বভাবগত কবিত্বশক্তির প্রসাদে তিনি তাঁর কাব্যে নাট্যগুণ ও উপন্যাসের বর্ণনা-নৈপুণ্যের সমন্বয় ঘটান। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ঔপন্যাসিকদের অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে ।
রামা - রমণী ।
কুড়্যা - কুঁড়েঘর।
ভেরাণ্ডা - রেড়িগাছ।
খাম - খুঁটি।
পাপিষ্ঠ - জ্যৈষ্ঠ মাসের তীব্র উষ্ণতায় ক্ষুব্ধ ফুল্লরা জ্যৈষ্ঠকে পাপিষ্ঠ বলে অভিহিত করেছে। কেননা এই মাসে খাবার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তার জোটে না।
খরতর - প্রচণ্ড।
কিরণ - আলো ৷
বেঙচের ফল - বেউচ; টক-মিষ্টি জাতীয় বুনো ফল ।
উপবাস - উপোস। না খেয়ে থাকা ।
পুরিল - পূর্ণ হলো ।
মহী - পৃথিবী ।
টুটয়ে - টুটে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়।
পসরা - পণ্য ।
বুলি - বুল থেকে বুলি। বুল অর্থ ঘুরে বেড়ানো। ফুল্লরা মাংসের পসরা নিয়ে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায় ।
খুদ-কুড়া - চালের ক্ষুদ্রতম অংশ; সামান্য খাবার বিশেষ ।
বরিষে - বর্ষিত হয় ।
সিতাসিত - শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষ। সিত ও অসিত; সিত – শুক্ল বা সাদা; অসিত – কৃষ্ণ বা কালো ।
ফণী - সাপ ।
ভাদ্রপদ - ভাদ্র মাস ।
এককার - একাকার।
অম্বিকা পূজা - দুর্গাপূজা।
বসন - পোশাক ।
করয়ে - করে।
বনিতা - নারী বা মেয়ে ।
হিম - শীত বা ঠান্ডা
যগজন - জগৎ-জন বা জগজ্জন; জগৎ-বাসী বা জগদ্বাসী।
সভার - সবার ।
হরিণের ছড় - হরিণের ছাল বা চামড়া ।
মাস্যর - অগ্রহায়ণ মাসের প্রাচীন নাম ।
গোঠ - গোচারণ ভূমি
সভাকার - সবার ।
দৈব - দেবতা; ঈশ্বর; ভগবান ।
যম-শম - মৃত্যু।
তথি - তথায়, সেখানে।
নিরমিলা - নির্মাণ করলে ।
বিধি - বিধাতা ।
পাড়ি - যা পাড়বার জন্য ।
পাছড়ি - দামি বস্ত্ৰ ৷
পুরাণ - পুরনো ৷
খোসলা - এক প্রকার গায়ের কাপড়।
দোপাটা - দুই ফালি কাপড় জোড়া দেওয়া পরিধেয় বস্ত্ৰ ।
কুজ্ঝটিকা - কুয়াশা ৷
মৃগয়া - শিকার ।
মৃগ - হরিণ।
চইত - চৈত্র মাস ।
চালু সেরে বান্ধা দিনু মাটিয়া পাথরা - চালের জন্য বন্ধক দিলাম মাটির পাত্র ।
আমানি - পান্তাভাতের পানি ।
অবধান - শোনা ।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ ‘ফুল্লরার বারোমাস্যা । প্রতিটি মঙ্গলকাব্যকে বেশ কয়েকটি পালায় বিভক্ত করে গীত ও বাদ্য সহযোগে পরিবেশন করা হতো। এক মঙ্গলবারে কাহিনি আরম্ভ করে সমাপ্ত করা হতো আরেক মঙ্গলবারে । এ কারণে কাব্যগুলো হতো দীর্ঘ পরিসরের। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ফুল্লরা ও কালকেতু চরিত্রকে ঘিরে। পশু শিকার ও মাংস বিক্রয়ের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে তারা; অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নেই বললেই চলে। ‘ফুল্লরার বারমাস্যা'য় মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বারো মাসের পটভূমিতে প্রকৃতির পরিবর্তন এবং ফুল্লরার দুঃখের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করেছেন। ফুল্লরার কণ্ঠস্বরে শোনা যাচ্ছে তার অভাব, দারিদ্র্যময় গার্হস্থ্য জীবনের বর্ণনা। উল্লেখ্য যে, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে ‘বারোমাসী' একটি বিশেষ কাব্যরীতি, যেখানে সংযোজিত হতো জীবনযাপন অথবা নারীর বিরহের বারোমাসভিত্তিক বিবরণ । বারোমাসী রচনায় মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বাস্তবানুগ সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ-শক্তির পরিচয় দিয়েছেন।
জান না কি জীব তুমি, জননী জন্মভূমি,
সে তোমায় হৃদয়ে রেখেছে।
থাকিয়া মায়ের কোলে, সন্তানে জননী ভোলে,
কে কোথায় এমন দেখেছে ৷।
ভূমিতে করিয়ে বাস, ঘুমেতে পুরাও আশ,
জাগিলে না দিবা বিভাবরী ।
কতকাল হরিয়াছ, এই ধরা ধরিয়াছ,
জননী জঠর পরিহরি ৷।
যার বলে বলিতেছ, যার বলে চলিতেছ,
যার বলে চালিতেছ দেহ।
যার বলে তুমি বলী, তার বলে আমি বলি,
ভক্তিভাবে কর তারে স্নেহ ৷৷
মিছা মণি মুক্তা হেম, স্বদেশের প্রিয় প্রেম,
তার চেয়ে রত্ন নাই আর ।
সুধাকরে কত সুধা, দূর করে তৃষ্ণা ক্ষুধা,
স্বদেশের শুভ সমাচার ৷।
ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসীগণে,
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া ।
কত রূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া ৷৷
স্বদেশের প্রেম যত, সেই মাত্র অবগত ,
বিদেশেতে অধিবাস যার ।
ভাব-তুলি ধ্যানে ধরে, চিত্রপটে চিত্র করে,
স্বদেশের সকল ব্যাপার ৷।
স্বদেশের শাস্ত্রমতে, চল সত্য ধর্মপথে,
সুখে কর জ্ঞান আলোচন ।
বৃদ্ধি কর মাতৃভাষা, পুরাও তাহার আশা,
দেশে কর বিদ্যা বিতরণ ৷।
[সংক্ষেপিত]
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই মার্চ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁচড়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ – উভয়েরই লক্ষণ দেখা যায়। তাই তিনি বাংলা সাহিত্যে যুগসন্ধিক্ষণের কবি হিসেবে পরিচিত। বিচিত্র অলংকারের ব্যবহার এবং ব্যঙ্গ-কৌতুক তাঁর কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর পারিবারিক ও সামাজিক জীবনই তাঁকে বিদ্রূপপ্রবণ করে তুলেছিল । তিনি ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুর পর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পাদনায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: রামচন্দ্র গুপ্ত সংগৃহীত ‘কবিতার সংকলন', বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কাব্যসংগ্রহ' এবং কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন সম্পাদিত ‘সংগ্রহ”। তিনি ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩এ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
জীব - প্রাণী। এ কবিতায় ভারতবাসীকে বোঝানো হয়েছে ।
পুরাও - পূর্ণ কর ।
বিভাবরী - রাত্রি।
হরিয়াছ - হরণ করিয়াছ। ‘এখানে যাপন করেছ অর্থে ব্যবহৃত
জঠর - পেট। উদর।
পরিহরি - পরিহার করে ।
বলিতেছ - বল লাভ করছ ।
চালিতেছ - চালাচ্ছে ।
বলী - বলবান ।
হেম - স্বর্ণ
সুধাকর - চাঁদ।
সুধা - জ্যোৎস্না। অমৃত।
অধিবাস - বাসস্থান।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের “স্বদেশ” কবিতাটি সংক্ষেপিত আকারে সংকলিত হয়েছে ‘কবিতা সংগ্রহ' গ্রন্থ থেকে। এটি একটি স্বদেশপ্রেমের কবিতা। কবি স্বদেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে সন্তানতুল্য দেশবাসীকে তার প্রতি যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মাতৃভূমির শক্তিতে বলীয়ান স্বদেশবাসীকে তিনি ভক্তিভাব নিয়ে স্বদেশের কল্যাণে নিয়োজিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কবির স্বাজাত্যবোধ এ কবিতায় এমনই প্রখর যে, তিনি বিদেশের মূল্যবান-কিছু ত্যাগ করেও স্বদেশের তুচ্ছ-কিছুকে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। কবির কাছে, স্বদেশের শুভ বা কল্যাণ মণি মুক্তার চেয়ে দামি । নিজ দেশের প্রতি মমত্ব ও প্রেম সে-ই যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে যে বিদেশে থাকে। দেশবাসীর পক্ষে সত্য ধর্মপথে চলে মাতৃভাষা চর্চা, জ্ঞান অন্বেষণ ও বিদ্যা বিতরণের মাধ্যমেই স্বদেশমাতার আশা পূর্ণ করা সম্ভব ।
“এতক্ষণে”- অরিন্দম কহিলা বিষাদে-
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলিশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী!
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরু জন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
উত্তরিলা বিভীষণ, “বৃথা এ সাধনা,
ধীমান্! রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে
তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব, রক্ষিতে
অনুরোধ?” উত্তরিলা কাতরে রাবণি;-
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!
রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে
আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে !
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধূলায়? হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে
কে তুমি? জনম তব কোন মহাকুলে?
কে বা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে
করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে;
যায় কি সে কভু, প্ৰভু, পঙ্কিল সলিলে,
শৈবালদলের ধাম? মৃগেন্দ্র কেশরী,
কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে
মিত্রভাবে? অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,
অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে ।
ক্ষুদ্রমতি নর, শূর, লক্ষ্মণ; নহিলে
অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?
কহ, মহারথী, এ কি মহারথীপ্রথা ?
নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে
এ কথা! ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া
এখনি! দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,
বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!
দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের! কী দেখি
ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগভে পশিল
দম্ভী; আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে ।
তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে
বনবাসী! হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে
ভ্রমে দুরাচার দৈত্য? প্ৰফুল্ল কমলে
কীটবাস? কহ তাত, সহিব কেমনে
হেন অপমান আমি,— ভ্রাতৃ-পুত্র তব?
তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;
“নহি দোষী আমি, বৎস; বৃথা ভর্ৎস মোরে
তুমি! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে !
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি । পরদোষে কে চাহে মজিতে?”
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্ৰ কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,—“ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
তুমি; – কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি,—এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে ?
গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি।”
[নির্বাচিত অংশ]
আধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রদূত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫এ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত, মাতা জাহ্নবী দেবী। মায়ের তত্ত্বাবধানে গ্রামেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। মধুসূদন ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার হিন্দু কলেজের স্কুল শাখায় ভর্তি হন। সেখানে ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে । ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে তিনি পিতৃপ্রদত্ত নামের শুরুতে ‘মাইকেল' শব্দ যোগ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে তাঁকে হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে শিবপুরের বিশপ্স কলেজে ভর্তি হতে হয়। সেখানেই তিনি গ্রিক, লাতিন ও হিব্রু ভাষা শিক্ষার সুযোগ পান। মধুসূদন বহু ভাষায় দক্ষ ছিলেন । ইংরেজি ও সংস্কৃতসহ ফরাসি, জার্মান এবং ইতালীয় ভাষাতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
হিন্দু কলেজে ছাত্রাবস্থায় তাঁর সাহিত্যচর্চার মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। কিন্তু বিদেশি ভাষার মোহ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি মাতৃভাষার কাছে ফিরে আসেন। মধুসূদন-পূর্ব হাজার বছরের বাংলা কবিতার ছন্দ ছিল পয়ার। একটি চরণের শেষে আর একটি চরণের মিল ছিল ওই ছন্দের অনড় প্রথা। মধুসূদন বাংলা কবিতার এ প্রথাকে ভেঙে দিলেন। তাঁর প্রবর্তিত ছন্দকে বলা হয় ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ'। তবে এটি বাংলা অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরই নবরূপায়ণ। বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেটেরও প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা নাটকের উদ্ভবযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তিনি। আধুনিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী' ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ এবং প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?” ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য', ‘মেঘনাদবধ-কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলি' । ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯এ জুন কলকাতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত মৃত্যুবরণ করেন ।
বিভীষণ - রাবণের কনিষ্ঠ সহোদর। রাম-রাবণের যুদ্ধে স্বপক্ষ ত্যাগকারী। রামের ভক্তি।
‘এতক্ষণে’– অরিন্দম কহিলা - রুদ্ধদ্বার নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের অনুপ্রবেশের অন্যতম কারণ যে পথপ্রদর্শক বিভীষণ, তা অনুধাবন করে বিস্মিত ও বিপন্ন মেঘনাদের প্রতিক্রিয়া ।
অরিন্দম - অরি বা শত্রুকে দমন করে যে। এখানে মেঘনাদকে বোঝানো হয়েছে।
পশিল - প্রবেশ করল।
রক্ষঃপুরে - রাক্ষসদের পুরীতে বা নগরে। এখানে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ।
রক্ষঃশ্রেষ্ঠ - রাক্ষসকুলের শ্রেষ্ঠ, রাবণ
তাত - পিতা। এখানে পিতৃব্য বা চাচা অর্থে ।
নিকষা - রাবণের মা।
শূলীশম্ভুনিভ - শূলপাণি মহাদেবের মতো ।
কুম্ভকৰ্ণ - রাবণের মধ্যম সহোদর ।
বাসববিজয়ী - দেবতাদের রাজা ইন্দ্ৰ বা বাসবকে জয় করেছে যে। এখানে মেঘনাদ । একই কারণে মেঘনাদের অপর নাম ইন্দ্রজিৎ ।
তস্কর - চোর ।
গঞ্জি - তিরস্কার করি ।
রামানুজ - রাম+অনুজ = রামানুজ। এখানে রামের অনুজ লক্ষ্মণকে বোঝানো
হয়েছে।
শমন-ভবনে - যমালয়ে ।
ভঞ্জিব আহবে - যুদ্ধদ্বারা বিনষ্ট করব ।
আহবে - যুদ্ধে।
ধীমান্ - ধীসম্পন্ন। জ্ঞানী।
রাঘব - রঘুবংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান । এখানে রামচন্দ্রকে বোঝানো হয়েছে ।
রাঘবদাস - রামচন্দ্রের আজ্ঞাবহ ।
রাবণি - রাবণের পুত্র। এখানে মেঘনাদকে বোঝানো হয়েছে।
স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে - বিধাতা চাঁদকে নিশ্চল আকাশে স্থাপন করেছেন।
বিধু - চাঁদ।
স্থাণু - নিশ্চল।
রক্ষোরথী - রক্ষকুলের বীর।
রথী - রথচালক। রথচালনার মাধ্যমে যুদ্ধ করে যে।
শৈবালদলের ধাম - পুকুর। বদ্ধ জলাশয় ।
শৈবাল - শেওলা ।
মৃগেন্দ্র কেশরী - কেশরযুক্ত পশুরাজ সিংহ ।
মৃগেন্দ্ৰ - পশুরাজ সিংহ ।
কেশরী - কেশরযুক্ত প্রাণী । সিংহ।
মহারথী - মহাবীর। শ্রেষ্ঠ বীর।
মহারথীপ্রথা - শ্রেষ্ঠ বীরদের আচরণ-প্রথা ।
সৌমিত্রি - লক্ষ্মণ । সুমিত্রার গর্ভজাত সন্তান বলে লক্ষ্মণের অপর নাম সৌমিত্রি।
নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগার - লঙ্কাপুরীতে মেঘনাদের যজ্ঞস্থান। এখানে যজ্ঞ করে মেঘনাদ যুদ্ধে যেত। ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’ যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে নিরস্ত্র মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইষ্টদেবতা বৈশ্বানর বা অগ্নিদেবের পূজারত অবস্থায় লক্ষ্মণের হাতে অন্যায় যুদ্ধে নিহত হয় ৷
প্রগল্ভে - নিৰ্ভীক চিত্তে ।
দম্ভী - দম্ভ করে যে। দাম্ভিক।
নন্দন কানন - স্বর্গের উদ্যান।
মহামন্ত্র বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী - মন্ত্রপূত সাপ যেমন মাথা নত করে।
লক্ষি - লক্ষ করে।
ভর্ৎস - ভর্ৎসনা বা তিরস্কার করছ।
মজাইলা - বিপদগ্রস্ত করলে ।
বসুধা - পৃথিবী ।
তেঁই - তজ্জন্য । সেহেতু।
রুষিলা - রাগান্বিত হলো ৷
বাসবত্রাস - বাসবের ভয়ের কারণ যে মেঘনাদ ।
মন্ত্র - শব্দ। ধ্বনি।
জীমূতেন্দ্ৰ - মেঘের ডাক বা আওয়াজ ।
বলী - বলবান। বীর।
জলাঞ্জলি - সম্পূর্ণ পরিত্যাগ।
শাস্ত্রে বলে, পরঃ পরঃ সদা! - শাস্ত্রমতে গুণহীন হলেও নির্গুণ স্বজনই শ্রেয়, কেননা গুণবান হলেও পর সর্বদা পরই থেকে যায় ৷
নীচ - হীন। নিকৃষ্ট। ইতর।
দুর্মতি - অসৎ বা মন্দ বুদ্ধি ।
“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” কাব্যাংশটুকু মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ-কাব্যে’-র ‘বধো' (বধ) নামক ষষ্ঠ সর্গ থেকে সংকলিত হয়েছে। সর্বমোট নয়টি সর্গে বিন্যস্ত ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে'র ষষ্ঠ সর্গে লক্ষ্মণের হাতে অন্যায় যুদ্ধে মৃত্যু ঘটে অসমসাহসী বীর মেঘনাদের। রামচন্দ্র কর্তৃক দ্বীপরাজ্য স্বর্ণলঙ্কা আক্রান্ত হলে রাজা রাবণ শত্রুর উপর্যুপরি দৈব-কৌশলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুর পর মেঘনাদকে পিতা রাবণ পরবর্তী দিবসে অনুষ্ঠেয় মহাযুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে বরণ করে নেন। যুদ্ধজয় নিশ্চিত করার জন্য মেঘনাদ যুদ্ধযাত্রার পূর্বেই নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইষ্টদেবতা অগ্নিদেবের পূজা সম্পন্ন করতে মনস্থির করে। মায়া দেবীর আনুকূল্যে এবং রাবণের অনুজ বিভীষণের সহায়তায়, লক্ষ্মণ শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশে সমর্থ হয়। কপট লক্ষ্মণ নিরস্ত্র মেঘনাদের কাছে যুদ্ধ প্রার্থনা করলে মেঘনাদ বিস্ময় প্রকাশ করে। শত শত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের অনুপ্রবেশ যে মায়াবলে সম্পন্ন হয়েছে, বুঝতে বিলম্ব ঘটে না তার। ইতোমধ্যে লক্ষ্মণ তলোয়ার কোষমুক্ত করলে মেঘনাদ যুদ্ধসাজ গ্রহণের জন্য সময় প্রার্থনা করে লক্ষ্মণের কাছে। কিন্তু লক্ষ্মণ তাকে সময় না দিয়ে আক্রমণ করে। এ সময়ই অকস্মাৎ যজ্ঞাগারের প্রবেশদ্বারের দিকে চোখ পড়ে মেঘনাদের; দেখতে পায় বীরযোদ্ধা পিতৃব্য বিভীষণকে মুহূর্তে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায় তার কাছে। খুল্লতাত বিভীষণকে প্রত্যক্ষ করে দেশপ্রেমিক নিরস্ত্র মেঘনাদ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, সেই নাটকীয় ভাষ্যই “বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” অংশে সংকলিত হয়েছে। এ অংশে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশদ্রোহিতার বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়েছে ঘৃণা। জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও জাতিসত্তার সংহতির গুরুত্বের কথা যেমন এখানে ব্যক্ত হয়েছে তেমনি এর বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রকে অভিহিত করা হয়েছে নীচতা ও বর্বরতা বলে ।
উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাল্মীকি-রামায়ণকে নবমূল্য দান করেছেন এ কাব্যে। মানবকেন্দ্রিকতাই রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সারকথা। ওই নবজাগরণের প্রেরণাতেই রামায়ণের রাম-লক্ষ্মণ মধুসূদনের লেখনীতে হীনরূপে এবং রাক্ষসরাজ রাবণ ও তার পুত্র মেঘনাদ যাবতীয় মানবীয় গুণের ধারকরূপে উপস্থাপিত। দেবতাদের আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাম-লক্ষ্মণ নয়, পুরাণের রাক্ষসরাজ রাবণ ও তার পুত্র মেঘনাদের প্রতিই মধুসূদনের মমতা ও শ্রদ্ধা ।
“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” কাব্যাংশটি ১৪ মাত্রার অমিল প্রবহমান যতিস্বাধীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। প্রথম পঙ্ক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় পক্তির চরণান্তের মিলহীনতার কারণে এ ছন্দ ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ' নামে সমধিক পরিচিত। এ কাব্যাংশের প্রতিটি পক্তি ১৪ মাত্রায় এবং ৮ + ৬ মাত্রার দুটি পর্বে বিন্যস্ত। লক্ষ করার বিষয় যে, এখানে দুই পঙ্ক্তির চরণান্তিক মিলই কেবল পরিহার করা হয়নি, যতিপাত বা বিরামচিহ্নের স্বাধীন ব্যবহারও হয়েছে বিষয় বা বক্তব্যের অর্থের অনুষঙ্গে। এ কারণে ভাবপ্রকাশের প্রবহমানতাও কাব্যাংশটির ছন্দের বিশেষ লক্ষণ হিসেবে বিবেচ্য।
১
সেই আদি-যুগে যবে অসহায় নর
নেত্ৰ মেলি ভবে,
চাহিয়া আকাশ পানে – কারে ডেকেছিল,
দেবে না মানবে?
কাতর আহ্বান সেই মেঘে মেঘে উঠি,
লুটি গ্রহে গ্রহে,
ফিরিয়া কি আসে নাই, না পেয়ে উত্তর,
ধরায় আগ্রহে?
সেই ক্ষুব্ধ অন্ধকারে, মরুৎ গর্জনে,
কার অন্বেষণ? সে নহে বন্দনা-গীতি, ভয়ার্ত-ক্ষুধার্ত
খুঁজিছে স্বজন!
২
আরক্ত প্রভাত সূর্য উদিল যখন
ভেদিয়া তিমিরে,
ধরিত্রী অরণ্যে ভরা, কদমে পিচ্ছিল
সলিলে শিশিরে!
শাখায় ঝাপটি পাখা গরুড় চিৎকারে
কাণ্ডে সর্পকুল,
সম্মুখে শ্বাপদ-সংঘ বদন ব্যাদানি
আছাড়ে লাঙ্গুল
; দংশিছে দংশক গাত্রে, পদে সরীসৃপ,
শূন্যে শ্যেন উড়ে;-
কে তাহারে উদ্ধারিল? দেব না মানব-
প্রস্তরে লগুড়ে?
৩
শীর্ণ অবসন্ন দেহ, গতিশক্তিহীন,
ক্ষুধায় অস্থির;
কে দিল তুলিয়া মুখে স্বাদু পক্বফল,
পত্রপুটে নীর?
কে দিল মুছায়ে অশ্রু? কে বুলাল কর
সর্বাঙ্গে আদরে?
কে নব পল্লবে দিল রচিয়া শয়ন
আপন গহ্বরে?
দিল করে পুষ্পগুচ্ছ, শিরে পুষ্পলতা,
অতিথি সৎকার!
নিশীথে বিচিত্র সুরে বিচিত্র ভাষায়
স্বপনসম্ভার!!
8
শৈশবে কাহার সাথে জলে স্থলে ভ্রমি
শিকার-সন্ধান?
কে শিখাল ধনুর্বেদ, বহিত্র চালনা,
চর্ম পরিধান ?
অর্ধদগ্ধ মৃগমাংস কার সাথে বসি,
করিনু ভক্ষণ?
কাষ্ঠে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালি কার হস্ত ধরি
কুর্দন নর্তন?
কে শিখাল শিলাস্তূপে, অশ্বত্থের মূলে
করিতে প্রণাম?
কে শিখাল ঋতুভেদ, চন্দ্ৰ-সূর্য মেঘে
দেব-দেবী নাম?
৫
কৈশোরে কাহার সনে মৃত্তিকা কর্ষণে
হইনু বাহির?
মধ্যাহ্নে কে দিল পাত্রে শালি অন্ন ঢালি,
দধি-দুগ্ধ-ক্ষীর?
সায়াহ্নে কুটির দ্বারে কার কণ্ঠ সাথে
নিবিদ উচ্চারি?
কার আশীর্বাদ লয়ে অগ্নি সাক্ষী করি
হইনু সংসারী?
কে দিল ঔষধি রোগে ক্ষতে প্রলেপন -
স্নেহে অনুরাগে?
কার ছন্দে – সোম গন্ধে – ইন্দ্র অগ্নি বায়ু -
দিল যজ্ঞ ভাগে?
৬
যৌবনে সাহায্যে কার নগর পত্তন,
প্রাসাদ নির্মাণ ?
কার ঋক্ সাম যজুঃ চরক সুশ্রুত,
সংহিতা পুরাণ?
কে গঠিল দুর্গ, সেতু, পরিখা, প্রণালী,
পথ, ঘাট, মাঠ?
কে আজ পৃথিবীরাজ – জলে স্থলে ব্যোমে
কার রাজ্যপাট?
পঞ্চভূত বশীভূত প্রকৃতি উন্নীত
কার জ্ঞানে বলে?
ভুঞ্জিতে কাহার রাজ্য – জন্মিলেন হরি
মথুরা কোশলে?
৭
প্রবীণ সমাজ পদে, আজি প্রৌঢ় আমি
জুড়ি দুই কর,
নমি, হে বিবর্ত-বুদ্ধি! বিদ্যুৎ-মোহন,
বজ্রমুষ্টিধর!
চরণে ঝটিকাগতি— ছুটিছ উধাও
দলি নীহারিকা ।
উদ্দীপ্ত তেজসনেত্র – হেরিছ নির্ভয়ে
সপ্তসূর্য শিখা ।
গ্রহে গ্রহে আবর্তন –গভীর নিনাদ
শুনিছ শ্রবণে?
দোলে মহাকাল - কোলে অণু পরমাণু
বুঝিছ স্পৰ্শনে ?
৮
নমি, হে সার্থক কাম! স্বরূপ তোমার
নিত্য অভিনব !
মর দেহে নহ মর, অমর অধিক
স্থৈর্য ধৈর্য তব ?
লয়ে সলাঙ্গুল দেহ, স্থূলবুদ্ধি তুমি
জন্মিলে জগতে!
শুষিলে সাগর শেষে, রসাইলে মরু
উড়ালে পর্বতে!
গড়িলে আপন মূর্তি – দেবতালাঞ্ছন
কালের পৃষ্ঠায় !
গড়িছ ভাঙিছ তর্কে, দর্শনে, বিজ্ঞান
আপন স্রষ্টায় ।
৯
নমি তোমা নরদেব! কী গর্বে গৌরবে
দাঁড়িয়েছ তুমি!
সর্বাঙ্গে প্রভাতরশ্মি, শিরে চূর্ণ মেঘ,
পদে শল্পভূমি ।
পশ্চাতে মন্দির-শ্রেণি, সুবর্ণ কলস,
ঝলসে কিরণে;
কলকণ্ঠ-সমুখিত নবীন উদ্গীথ
গগনে পবনে।
হৃদয়-স্পন্দন সনে ঘুরিছে জগৎ
চলিছে সময়;
ভ্রূভঙ্গে – ফিরিছ সঙ্গে – ক্রমব্যতিক্রম -
উদয়-বিলয় ।
১০
নমি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ-চণ্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস!
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু, বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ!
নমি কৃষি-তন্তুজীবী, স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার!
অদ্রিতলে শিলাখণ্ড – দৃষ্টি অগোচরে,
বহ অদ্রি-ভার!
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছ নীরবে
হে পূজ্য, হে প্রিয়!
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে, -
আত্মার আত্মীয়।
অক্ষয়কুমার বড়াল ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার চোরাবাগান এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম কালীচরণ বড়াল । কলকাতার হেয়ার স্কুলে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সেখানে অধ্যয়ন শেষ না-করেই কর্মজীবনে চলে যান। কর্মজীবনে তিনি ব্যাংক ও ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে না পারলেও নিজের চেষ্টায় তিনি প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। ১২৮৯ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গদর্শন' পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা “রজনীর মৃত্যু” প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমারের কাব্যে আবেগের আতিশয্যের চেয়ে ভাবগত সংহতি ও বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনাই প্রধান। তাঁর কাব্যে ইংরেজ কবি ব্রাউনিং-এর বিশেষ প্রভাব আছে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রদীপ’ । অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ‘কনকাঞ্জলি’, ‘ভুল’, ‘শঙ্খ’, ‘এষা’। এছাড়াও তাঁর কিছু অনুবাদ কবিতা ও গান রয়েছে। অক্ষয়কুমার বড়াল ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯এ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
মরুৎ - বাতাস ।
গরুড় - পুরাণে বর্ণিত পাখির রাজা ও বিষ্ণুর বাহন।
শ্বাপদ - (কুকুরের মতো পা আছে এমন) হিংস মাংসাশী পশু ।
ব্যাদানি - হা করে। প্রসারিত করে।
লাঙ্গুল - পশুর লেজ। পুচ্ছ।
শ্যেন - একজাতীয় শিকারি পাখি। বাজপাখি।
লগুড় - ছোট লাঠি । গদা।
কে তাহরে উদ্ধারিল? - প্রকৃতি প্রদত্ত বুদ্ধি ও শক্তির সাহায্যে মানুষ নিজেই নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে – এই হচ্ছে কথাটির তাৎপর্য।
পত্রপুট - পাতা দিয়ে তৈরি পাত্র। পাতার ঠোঙা।
শৈশবে - কবি মানবসভ্যতার তিনটি স্তর নির্দেশ করেছেন। এর প্রথম স্তর হচ্ছেশৈশব। এ সময় মানুষের সামাজিক জীবনের সূচনা হয়। মানুষ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ও পরস্পরকে সহযোগিতা করতে শেখে ।
ভ্ৰমি - ভ্রমণ করে। বিচরণ করে, বেড়িয়ে।
ধনুর্বেদ - তির নিক্ষেপ কৌশল সংক্রান্ত জ্ঞান বা বিদ্যা। প্রাচীন অস্ত্রবিদ্যা ।
কাষ্ঠে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালি - মানুষ যখন থেকে আগুন জ্বালাতে শিখেছে তখন থেকেই সভ্যতার প্রথম ধাপে পা দিয়েছে।
কে শিখাল...করিতে প্রণাম - প্রকৃতির রহস্য ও বিস্ময়কে কেন্দ্র করে প্রথম ধর্মচেতনার উন্মেষ। এই
আদি ধর্মবিশ্বাস ছিল মূলত প্রাকৃতিক শক্তির আরাধনা (Natural religion)।
বহিত্র - নৌকা। পোত । বৈঠা । দাঁড়।
কুর্দন - আনন্দে লাফালাফি করা ।
কৈশোরে - মানবসভ্যতার দ্বিতীয় স্তরকে কবি কৈশোর বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় বৈদিক যুগেরও আদিকালের লক্ষণ এখানে স্পষ্ট । এই স্তবকের নিবিদ, ইন্দ্ৰ, অগ্নি, যজ্ঞভাগ ইত্যাদি শব্দ লক্ষণীয়। এসব শব্দ বৈদিক সাহিত্যেই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে।
নিবিদ - বৈদিক মন্ত্রবিশেষ ।
ইন্দ্ৰ - হিন্দু পুরাণে বর্ণিত দেবতাদের রাজা ।
অগ্নি - আগুন। বৈদিক দেবতা বিশেষ ।
বায়ু - বাতাস। অন্তরিক্ষের দেবতা ।
যজ্ঞভাগ - যজ্ঞে যা আহুতি দেওয়া হতো তার এক-এক অংশ এক-এক দেবতার প্রাপ্য বলে বিবেচিত হয়। এটাই যজ্ঞভাগ ।
যৌবনে - মানবসভ্যতার এ পর্যায়ে মানুষের বিদ্যা, বুদ্ধি, সৃষ্টিক্ষমতা ও অবদানের অসাধারণত্ব লক্ষণীয়। কবি চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমাজ শাসনব্যবস্থা, সাহিত্য, ইতিহাস, প্রকৌশলবিজ্ঞানের কথা এখানে উল্লেখ করেছেন। তবে বিজ্ঞানের কল্যাণেই মানুষ প্রকৃতির ওপর সার্বিক আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।
ঋক্ - অন্যতম বেদ গ্রন্থ। হিন্দু পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার চার মুখ থেকে চারটি বেদের সৃষ্টি। এগুলো হলো : ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব।
যজুঃ - যজুর্বেদ। চতুর্বেদের অন্যতম বেদ।
চরক - প্রাচীন ভারতবর্ষের চিকিৎসক ঋষি এবং চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদপ্রণেতা।
সুশ্রুত - চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ুর্বেদের রচয়িতা জনৈক প্রাচীন ঋষি। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘সুশ্রুত- সংহিতা'।
সংহিতা - যেখানে কোনো বিষয় সংকলিত বা সংহত করা হয়। যেমন : ঋগ্বেদ-সংহিতা, মনু-সংহিতা। প্রত্যেক বেদের মন্ত্রভাগ কিংবা প্রথম ও প্রধান অংশ ।
পুরাণ - প্রাচীন ইতিবৃত্ত ও কিংবদন্তিমূলক ধর্মশাস্ত্র। যেমন : বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ ইত্যাদি ।
পরিখা - দুর্গ ইত্যাদির চার পাশের গভীর খাত। গড়খাই ।
প্ৰণালী - দুই বৃহৎ জলভাগকে সংযুক্ত করে এমন সংকীর্ণ জলভাগ ।
ব্যোম - আকাশ ।
পঞ্চভূত - প্রাচীন ধারণা অনুসারে জগৎ সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান : ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম ।
ভুঞ্জিতে - ভোগ করতে।
হরি - নারায়ণ। বিষ্ণু । কৃষ্ণ ।
মথুরা - উত্তর প্রদেশের প্রাচীন এ নগরী শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি এবং হিন্দুদের তীর্থস্থান।
কোশলে - প্রাচীন অযোধ্যা রাজ্যে।
জন্মিলেন হরি মথুরা কোশলে - হিন্দু পুরাণ মতে, মানবসভ্যতার মহিমায় আকৃষ্ট হয়ে স্রষ্টা মানব অবতারের রূপ নিয়ে মথুরায় কৃষ্ণ হয়ে এবং কোশলে রামচন্দ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রবীণ সমাজ পদে - মানবসভ্যতার প্রৌঢ়ত্ব পর্বে মানুষ এক বিশাল মহিমায় উত্তীর্ণ হয়েছে। বিশাল সমাজের শক্তিতে মানুষ অপরিসীম শক্তির অধিকারী হয়েছে। এই স্তবকে কবি তারই গৌরবকীর্তন করেছেন। এই স্তবকে প্রধানত পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মানুষ যেসব শক্তি অর্জন করেছে সেগুলোর উল্লেখ আছে ।
বিবর্ত-বুদ্ধি - মানুষের জ্ঞানশক্তি ক্রমপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ ও বিকশিত হয়েছে।
বিদ্যুৎ-মোহন - বিদ্যুৎকে বা তড়িৎশক্তিকে যে মুগ্ধ ও বশীভূত করেছে।
বজ্রমুষ্টিধর - বজ্রকে যে হাতের মুঠোয় ধরতে সক্ষম হয়েছে।
নীহারিকা - দূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ যা তুষারের মতো দেখায় ।
চরণে ঝটিকাগতি... দলি নীহারিকা - মানুষের চলার গতি সীমিত। কিন্তু বিজ্ঞানের শক্তিতে মানুষ মহাবিশ্বের নক্ষত্রলোকে যাওয়ার গতি অর্জন করেছে।
তেজসনেত্র - দীপ্তিময় চোখ ।
উদ্দীপ্ত তেজসনে ...সপ্তসূর্য শিখা জ্বলন্ত - মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টির সীমা খুব বেশি নয়। কিন্তু টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মানুষ সূর্যের মতো বিভিন্ন নক্ষত্রও পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে ।
গ্রহে গ্রহে... শুনিছ শ্রবণে - মানুষ বিজ্ঞানের সাহায্যে মহাজাগতিক ধ্বনি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে
সক্ষম হয়েছে।
দোলে মহাকাল-কোলে ..বুঝিছ স্পৰ্শনে - মানুষ জগতের সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনে অণু-পরমাণুর নিত্যগতিশীল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পেরেছে।
নমি, হে সাৰ্থক কাম - মানুষের ইচ্ছা কর্ম ও সৃজনের সাফল্যের জন্য কবি মানুষের বন্দনা করছেন ।
মরদেহে নহ মর - মানুষ মরণশীল । কিন্তু কর্ম অবদানে মানুষ অমরত্বের মহিমা অর্জন করেছে।
সলাঙ্গুল - লেজসহ ।
লয়ে সলাঙ্গুল দেহ - লেজবিশিষ্ট বানরজাতীয় প্রাণীর বিবর্তিত ও বিকশিত রূপই বর্তমান মানুষ ।
রসাইলে মরু - জলসেচে মরুভূমির মরুময়তা ঘুচিয়ে তাকে উর্বর ও রসযুক্ত করেছে মানুষ।
গড়িলে আপন মূর্তি দেবতা-লাঞ্ছন - মানবসভ্যতার বিকাশের ফলে জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি ও অবদানের দিক থেকে
মানুষের যে বিশাল মহিমাময় মূর্তি গড়ে উঠেছে তার কাছে দেবতার মহিমা ম্লান ও খাটো হয়ে গেছে।
নরদেব - মানবদেবতা। সর্বমানবের শক্তি ও মহিমার এক প্রতীকীরূপ।
শল্পভূমি - তৃণক্ষেত্র। কচি ঘাসে আচ্ছাদিত মাঠ ।
উদগীথ - বেদমন্ত্র । বৈদিক স্তোত্রগান ।
কলকণ্ঠ সমুত্থিত...গগনে পবনে - আকাশে বাতাসে দেবতার মহিমাজ্ঞাপক মন্ত্রের জায়গায় মানুষের মহিমাকীর্তনসূচক নতুন মন্ত্রগীতি অজস্র কণ্ঠে গীত হচ্ছে।
ক্রম-ব্যতিক্রম - নিয়ম ও অনিয়ম।
উদয়-বিলয় - সৃষ্টি ও ধ্বংস।
হৃদয়-স্পন্দন সনে... উদয়-বিলয় - পৃথিবীতে মানুষের ভূমিকা এত ব্যাপক ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে যে, নিয়ম ও অনিয়ম, সৃষ্টি ও ধ্বংস সবই মানুষের নিয়ন্ত্রণে চলছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
আদ্বিজ-চণ্ডাল - ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত। সর্বস্তরের মানুষ।
নমি আমি...প্রভু, ক্রীতদাস - সর্বস্তরের সকল মানুষকে কবি বন্দনা করেছেন। এ স্তবকে কবি মানবতার মহিমাকে স্পষ্টভাবে সমুন্নত করেছেন।
কৃষি-তন্ত্রজীবী - কৃষক ও তাঁতি ।
তক্ষক - ছুতোরের কাজ ।
অদ্রি - পর্বত।
“মানব-বন্দনা” কবিতাটি সংকলিত হয়েছে অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘প্রদীপ' কাব্যগ্রন্থ থেকে। “মানব-বন্দনা” কবিতায় কবি মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানুষের অবদান ও মহিমাকে তুলে ধরেছেন। কবি মানুষকেই মানুষের দেবতা বলে গণ্য করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও বৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদীর মতবাদের আলোকে এটি রচিত। পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির রহস্যগাথা বিবৃত হয়েছে এ কবিতায় । বিবৃত হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ যে সভ্যতা নির্মাণ করে চলেছে তারও ইতিহাস। মানুষ তার নিজ সৃষ্টিশীল প্রতিভাবলে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছে যে আপন কর্তৃত্ব ও মহিমা তারই বন্দনা করেছেন কবি এ কবিতায়। কবিতাটির ছন্দ অক্ষরবৃত্ত (পয়ার) । পর্ববিন্যাস : যুগল চরণের প্রথমটির পর্ব ৮/৬ এবং দ্বিতীয়টি ৬ মাত্রার। তবে অন্ত্যমিলের ভিত্তিতে এই যুগল চরণকে ২০ মাত্রার চরণ (৮।৬।৬) হিসেবে ধরাই সংগত।
“সুখ সুখ” বলে তুমি, কেন কর হা-হুতাশ,
সুখ ত পাবে না কোথা, বৃথা সে সুখের আশ!
পথিক মরুভূ মাঝে খুঁজিয়া বেড়ায় জল,
জল ত মিলে না সেথা, মরীচিকা করে ছল!
তেমতি এ বিশ্ব মাঝে, সুখ ত পাবে না তুমি,
মরীচিকা প্রায় সুখ, - এ বিশ্ব যে মরুভূমি!
ধন রত্ন সুখৈশ্বর্য কিছুতেই সুখ নাই,
সুখ পর-উপকারে, তারি মাঝে খোঁজ ভাই!
‘আমিত্ব’কে বলি দিয়া স্বার্থ ত্যাগ কর যদি,
পরের হিতের জন্য ভাব যদি নিরবধি!
নিজ সুখ ভুলে গিয়ে ভাবিলে পরের কথা,
মুছালে পরের অশ্রু— ঘুচালে পরের ব্যথা !
আপনাকে বিলাইয়া দীনদুঃখীদের মাঝে,
বিদূরিলে পর দুঃখ সকালে বিকালে সাঁঝে!
তবেই পাইবে সুখ আত্মার ভিতরে তুমি,
যা রুপিবে— তাই পাবে, সংসার যে কর্মভূমি!
১৮৫৭ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার আগলা-পূর্বপাড়া গ্রামে কবি কায়কোবাদের জন্ম। তাঁর প্রকৃত নাম মুহম্মদ কাজেম আল কুরায়শী। ‘কায়কোবাদ' কবির সাহিত্যিক নাম । প্রথমে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ভর্তি হলেও পিতার অকালমৃত্যুতে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। পরে মাদরাসায় ভর্তি হয়ে এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং আগলা গ্রামেরই পোস্টমাস্টার পদে চাকরি গ্রহণ করেন ।
বাংলা কাব্যধারায় কায়কোবাদ গীতিকবি হিসেবেই খ্যাত। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি ‘বিরহবিলাপ' কাব্য রচনা করেন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ও মারাঠা শক্তির পতনের কাহিনি নিয়ে তাঁর রচিত ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্যের জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য হলো : ‘কুসুমকানন’, ‘শিবমন্দির’, ‘আমিয় ধারা’, ‘মহরম শরীফ ও ‘শ্মশান-ভস্ম’। কবি কায়কোবাদ ১৯২৫ সালে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ কর্তৃক 'কাব্যভূষণ, বিদ্যাভূষণ ও সাহিত্যরত্ন' উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৫১ সালের ২১এ জুলাই তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
মরুভূ - মরুভূমি ।
জল তো মিলে না... করে ছল - জল, উদ্ভিদ ও জীবশূন্য বালুকাময় বিস্তীর্ণ স্থান হচ্ছে মরুভূমি। সেই মরুভূমির মাঝে পানীয় জল খুঁজে পাওয়া ভার । কখনো কখনো উত্তপ্ত বিস্তীর্ণ বালুরাশিকে সমুদ্র বলে ভ্রম হয়। এই ভ্রান্তিই হলো মরীচিকা, ছলনা বা মোহ। অর্থাৎ ধন-রত্ন অর্থ-সম্পদ প্রকৃত সুখের নিয়ামক নয়। সুখ খুঁজতে গিয়ে এসব উপকরণের পেছনে ছোটা মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই ৷
এ বিশ্ব যে মরুভূমি - অর্থ-বিত্ত, ধন-সম্পদের অধিকারী মানুষ প্রকৃত সুখী নয় । প্রকৃত সুখ হলো আত্ম-সুখ। ধন-সম্পদ বাহ্য-সুখ। বাহ্য-সুখের অধিকারী মানুষের হৃদয়ে মরুভূমি ।
‘আমিত্ব’কে বলি দিয়া - অহমিকা বিসর্জন দিয়ে ।
বিদূরিলে পর দুঃখ বিকালে সাঁঝে - সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় অর্থাৎ সারা জীবন সবার দুঃখ ঘোচালে ।
তবে পাইবে সুখ আত্মার ভিতরে - সবার দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণা দূর করতে পারলে বা করার প্রচেষ্টায় যে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করা যায় কবি সেকথাই এখানে বলেছেন।
যা রুপিবে – তাই পাবে - যা বপন করবে তার ফল পাবে, অর্থাৎ ভালো কাজের জন্য ভালো ফল পাওয়া যায়।
কায়কোবাদ রচনাবলির অন্তর্গত ‘অমিয়-ধারা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে “সুখ” কবিতাটি সংকলন করা হয়েছে। ১৯২৩ সালে ‘অমিয়-ধারা’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ।
মরুভূমিতে পানীয় জল খোঁজার মতোই মানুষ সুখের অন্বেষণে মশগুল। ধন-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব ইত্যাকার সম্পদের অধিকারী হয়ে মানুষ সুখী হতে চায়। কিন্তু কবি বলেছেন, বিশাল সম্পদের অধিকারী হয়েও প্রকৃত সুখী হওয়া যায় না । প্রকৃত সুখী হতে হলে সবাইকে তার ভেতরকার ‘আমিত্ব’কে বিসর্জন দিয়ে নিরহঙ্কারী হতে হবে। বিসর্জন দিতে হবে আপন স্বার্থপর সুখান্বেষা। নিজের সকল কর্ম নিয়োজিত করতে হবে পরহিতে। দীনদুঃখীর ব্যথা দূর করার মধ্যেই খুঁজতে হবে আত্মসুখ। অপরের উপকারের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। অপরের দুঃখ-দুর্দশা বিদূরিত করতে পারার মধ্যেই প্রকৃত অর্থে মানুষের আত্মিক সুখ ও শান্তি নিহিত বলে কবি মনে করেন
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা-
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা ৷৷
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা-
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা ॥
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা-
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা ৷৷
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে-
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ৷।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যারে খুশি তারে দাও -
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে ॥
যত চাও তত লও তরণী-পরে ।
আর আছে— আর নাই, দিয়েছি ভরে ॥
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে-
এখন আমারে লহো করুণা করে ৷৷
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি-
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী ।।
অসামান্য প্রতিভার অধিকারী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ। তিনি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্যসাধনার একটি বৃহৎকাল বাংলা সাহিত্যের ‘রবীন্দ্রযুগত নামে পরিচিত। মানবধর্মের জয় ও সৌন্দর্য-তৃষ্ণা রোমান্টিক এই কবির কবিতার মূল সুর। কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি ও সংগীত রচনায় রবীন্দ্রনাথ কালজয়ী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ছিলেন অনন্য চিত্রশিল্পী, অনুসন্ধিৎসু বিশ্বপরিব্রাজক, দক্ষ সম্পাদক এবং অসামান্য শিক্ষা-সংগঠক ও চিন্তক। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে নিরুৎসাহী হলেও ‘বিশ্বভারতী' নামের বিশ্ববিদ্যালয়-এর তিনি স্বাপ্নিক ও প্রতিষ্ঠাতা । মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য 'বনফুল' প্রকাশিত হয়। ‘গীতাঞ্জলি' এবং অন্যান্য কাব্যের কবিতার সমন্বয়ে স্ব-অনূদিত ‘Song Offerings' গ্রন্থের জন্য ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এশীয় হিসেবে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলা ছোটগল্পের তিনি পথিকৃৎ ও শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ‘মানসী’, ‘সোনার তরী', ‘চিত্রা', ‘ক্ষণিকা', 'বলাকা', ‘পুনশ্চ', ‘জন্মদিনে’, ‘শেষ লেখা' তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। কাব্যনাট্য 'বিসর্জন' ও 'চিত্রাঙ্গদা' এবং কাহিনি-কবিতার সংকলন 'কথা' ও 'কাহিনি' তাঁর ভিন্ন স্বাদের রচনা। ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
গরজে - গর্জন করে ৷
ভারা ভারা - ‘ভারা' অর্থ ধান রাখার পাত্র। এরকম পাত্রের সমষ্টি বোঝাতে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে।
ক্ষুরধারা - ক্ষুরের মতো ধারালো যে প্রবাহ বা স্রোত ।
খরপরশা - ধারালো বর্শা। এখানে ধারালো বর্শার মতো ।
আমি - সাধারণ অর্থে কৃষক । প্রতীকী অর্থে শিল্পস্রষ্টা কবি ।
আমি একেলা - কৃষক কিংবা শিল্পস্রষ্টা কবির নিঃসঙ্গ অবস্থা।
চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা - ধানক্ষেতটি ছোট দ্বীপের আঙ্গিকে চিত্রিত। তার পাশে ঘূর্ণায়মান স্রোতের উদ্দামতা। নদীর ‘বাঁকা' জলস্রোতে বেষ্টিত ছোট ক্ষেতটুকুর আশু বিলীয়মান হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে এ অংশে। ‘বাঁকা জল’ এখানে অনন্ত কালস্রোতের প্রতীক ।
তরুছায়ামসী-মাখা - ওপারের মেঘে ঢাকা গ্রামটি যেন গাছের ছায়ার কালো রঙে মাখানো।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে - ক্ষুরের মতো ধারালো জলস্রোতে গান গাইতে গাইতে যে মাঝি পারের দিকে এগিয়ে আসছে, রবীন্দ্র-ভাবনায় সে নির্মোহ মহাকালের প্রতীক ।
কোনো দিকে নাহি চায় - মহাকালের প্রতীক এই মাঝি নিরাসক্ত বলেই তার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিপাত নেই ।
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে - এই আগন্তুক মাঝি কৃষক বা শিল্পস্রষ্টা কবির হয়ত চেনা। কেননা, চেনা মনে হলেও কৃষক বা শিল্পস্রষ্টা কবির সংশয় থেকেই যায় ।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে ? - নির্বিকার মাঝির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কৃষক বা কবির চেষ্টা। ‘বিদেশ’ এখানে চিরায়ত শিল্পলোকের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে - চিরায়ত শিল্পলোকে ঠাঁই পাওয়ার জন্যই কৃষকরূপী কবির ব্যাকুল অনুনয় এখানে প্রকাশিত ।
আমার সোনার ধান - কৃষকের শ্রেষ্ঠ ফসল। ব্যঞ্জনার্থে শিল্পস্রষ্টা কবির সৃষ্টিসম্ভার।
আর আছে, আর নাই, দিয়েছি ভরে - ছোট জমিতে উৎপন্ন ফসলের সবটাই অর্থাৎ কবির সমগ্র সৃষ্টি তুলে দেওয়া হয়েছে মহাকালের স্রোতে ভেসে আসা সোনার তরী-রূপী চিরায়ত শিল্পলোকে ৷
থরে বিথরে - স্তরে স্তরে, সুবিন্যস্ত করে ।
এখন আমারে লহো করুণা করে - ফসল বা সৃষ্টিসম্ভার তুলে দেওয়া হয়েছে নৌকায়। এখন ফসল বা সৃষ্টির স্রষ্টা স্থান পেতে চায় ওই মহাকালের নৌকায় ।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী - সোনার তরীতে মহৎ সৃষ্টিরই স্থান সংকুলান হয় কেবল । ব্যক্তিসত্তা ও তার শারীরিক অস্তিত্বকে নিশ্চিতভাবে হতে হয় মহাকালের নিষ্ঠুর কালগ্রাসের শিকার ।
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি - নিঃসঙ্গ অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে আসন্ন ও অনিবার্য মৃত্যুর প্রতীক্ষার ইঙ্গিত। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “মহাকাল আমার সর্বস্ব লইয়া যায় বটে, কিন্তু আমাকে ফেলিয়া যায় বিস্মৃতি ও অবহেলার মধ্যে। ... সোনার তরীর নেয়ে আমার সোনার ধান লইয়া যায় খেয়াপারে, কিন্তু আমাকে লয় না ।”
“সোনার তরী” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতা। শতাধিক বছর ধরে এ কবিতা বিপুল আলোচনা ও নানামুখী ব্যাখ্যায় নতুন নতুন তাৎপর্যে অভিষিক্ত। একই সঙ্গে, কবিতাটি গূঢ় রহস্য ও শ্রেষ্ঠত্বেরও স্মারক । মহৎ সাহিত্যের একটি বিশেষ গুণ হলো কালে কালে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেচনার আলোকে তার শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হতে থাকে । বাংলা কবিতার ইতিহাসে “সোনার তরী” তেমনি আশ্চর্যসুন্দর এক চিরায়ত আবেদনবাহী কবিতা ।
কবিতাটিতে দেখা যায়, চারপাশের প্রবল স্রোতের মধ্যে জেগে থাকা দ্বীপের মতো ছোটো একটি ধানক্ষেতে উৎপন্ন সোনার ধানের সম্ভার নিয়ে অপেক্ষারত নিঃসঙ্গ এক কৃষক। আকাশের ঘন মেঘ আর ভারী বর্ষণে পাশের খরস্রোতা নদী হয়ে উঠেছে হিংস্র। চারদিকের ‘বাঁকা জল কৃষকের মনে সৃষ্টি করেছে ঘনঘোর আশঙ্কা ৷ এরকম এক পরিস্থিতিতে ওই খরস্রোতা নদীতে একটি ভরাপাল সোনার নৌকা নিয়ে বেয়ে আসা এক মাঝিকে দেখা যায়। উৎকণ্ঠিত কৃষক নৌকা কূলে ভিড়িয়ে তার উৎপাদিত সোনার ধান নিয়ে যাওয়ার জন্য মাঝিকে সকাতরে মিনতি জানালে ওই সোনার ধানের সম্ভার নৌকায় তুলে নিয়ে মাঝি চলে যায়। ছোট নৌকা বলে স্থান সংকুলান হয় না কৃষকের । শূন্য নদীর তীরে আশাহত কৃষকের বেদনা গুমড়ে মরে ।
এ কবিতায় নিবিড়ভাবে মিশে আছে কবির জীবনদর্শন । মহাকালের স্রোতে জীবন-যৌবন ভেসে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকে মানুষেরই সৃষ্ট সোনার ফসল। তার ব্যক্তিসত্তা ও শারীরিক অস্তিত্বকে নিশ্চিতভাবে হতে হয় মহাকালের নিষ্ঠুর কালগ্রাসের শিকার।
“সোনার তরী” মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। এর অধিকাংশ পক্তি ৮+৫ মাত্রার পূর্ণপর্বে বিন্যস্ত ।
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে –
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি ।
জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।
আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,
এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক -
রয়ে গেছে ফাঁক ।
প্রকৃতির ঐকতানস্রোতে
নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে;
তাদের সবার সাথে আছে মোর এইমাত্ৰ যোগ-
সঙ্গ পাই সবাকার, লাভ করি আনন্দের ভোগ,
পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,
বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার ৷
চাষি খেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার ।
অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে
সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে ।
মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে ।
জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।
তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা
আমার সুরের অপূর্ণতা ।
আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী ।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।
এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক মনের ৷
মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার-
প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার,
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি
রসে পূর্ণ করি দাও তুমি ।
অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি
তাই তুমি দাও তো উদ্বারি ।
সাহিত্যের ঐকতানসংগীতসভায়
একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায় -
মূক যারা দুঃখে সুখে,
নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে,
ওগো গুণী,
কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি ।
[সংক্ষেপিত]
অসামান্য প্রতিভার অধিকারী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ। তিনি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্যসাধনার একটি বৃহৎকাল বাংলা সাহিত্যের ‘রবীন্দ্রযুগত নামে পরিচিত। মানবধর্মের জয় ও সৌন্দর্য-তৃষ্ণা রোমান্টিক এই কবির কবিতার মূল সুর। কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি ও সংগীত রচনায় রবীন্দ্রনাথ কালজয়ী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ছিলেন অনন্য চিত্রশিল্পী, অনুসন্ধিৎসু বিশ্বপরিব্রাজক, দক্ষ সম্পাদক এবং অসামান্য শিক্ষা-সংগঠক ও চিন্তক। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে নিরুৎসাহী হলেও ‘বিশ্বভারতী' নামের বিশ্ববিদ্যালয়-এর তিনি স্বাপ্নিক ও প্রতিষ্ঠাতা । মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য 'বনফুল' প্রকাশিত হয়। ‘গীতাঞ্জলি' এবং অন্যান্য কাব্যের কবিতার সমন্বয়ে স্ব-অনূদিত ‘Song Offerings' গ্রন্থের জন্য ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এশীয় হিসেবে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলা ছোটগল্পের তিনি পথিকৃৎ ও শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ‘মানসী’, ‘সোনার তরী', ‘চিত্রা', ‘ক্ষণিকা', 'বলাকা', ‘পুনশ্চ', ‘জন্মদিনে’, ‘শেষ লেখা' তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। কাব্যনাট্য 'বিসর্জন' ও 'চিত্রাঙ্গদা' এবং কাহিনি-কবিতার সংকলন 'কথা' ও 'কাহিনি' তাঁর ভিন্ন স্বাদের রচনা। ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
বিপুলা - বিশাল প্রশস্ত। এখানে নারীবাচক শব্দ হিসেবে বিপুলা বলে পৃথিবীকে বোঝানো হয়েছে।
‘বিশাল বিশ্বের আয়োজন; মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।’ - জীব ও জড়-বৈচিত্র্যের বিশাল সম্ভার নিয়ে এই বিশাল বিশ্বজগৎ। কিন্তু কবির মন জুড়ে রয়েছে তারই ছোট একটি কোণ ।
‘যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী কুড়াইয়া আনি ।’ - কবি তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করার জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের সম্পদ কুড়িয়ে আনেন।
‘জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।' - নানা সূত্র থেকে জ্ঞান আহরণ করে কবি নিজের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন।
স্বরসাধনা - এখানে সুর বা সংগীত সাধনা বোঝানো হয়েছে।
‘এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক রয়ে গেছে ফাঁক।'- কাব্যসংগীতের ক্ষেত্রে কবি যে স্বরসাধনা করেছেন তাতে ঘাটতি রয়ে গেছে। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট সুর, সমস্বর। এখানে বহু সুরের
ঐকতান - সমন্বয়ে এক সুরে বাঁধা পৃথিবীর সুরকে বোঝানো হয়েছে। সকল মানুষের কথা বলা সাহিত্য-সুরকে তিনি সাহিত্যের ঐকতান বলেছেন।
‘অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।' - সম্মানবঞ্চিত ব্রাত্যজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমাজের উচ্চ মঞ্চে কবি আসন গ্রহণ করেছেন। তাই সেখানকার সংকীর্ণ জানালা দিয়ে বৃহত্তর সমাজ ও জীবনকে তিনি দেখতে পারেননি ।
‘মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে, ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।' - মাঝেমধ্যে কবি ব্রাত্য মানুষের পাড়ায় ক্ষণিকের জন্য উঁকি দিয়েছেন। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগসূত্র রচনা সম্ভব হয়নি।
‘জীবনে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।' - জীবনের সঙ্গে জীবনের সংযোগ ঘটাতে না পারলে শিল্পীর সৃষ্টি কৃত্রিম পণ্যে পরিণত হয়। ব্রাত্য তথা প্রান্তিক মানুষকে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে যোগ্য স্থান দিলেই তবে শিল্প সাধনা পূর্ণতা পায় ।
‘এসো কবি অখ্যাতজনের নির্বাক মনের - রবীন্দ্রনাথ এখানে সেই অনাগত কবিকে আহ্বান করছেন, যিনি অখ্যাত মানুষের, অব্যক্ত মনের জীবনকে আবিষ্কার করতে সমর্থ হবেন।
রস - এখানে সাহিত্যরস বা শিল্পরস বোঝানো হয়েছে। কবিরা রসসৃষ্টির জন্য কবিতা রচনা করেন। সেই রস সৃষ্টি হয় পাঠকের অন্তরে।
‘অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি রসে পূর্ণ করি দাও তুমি।'- জেলে-তাঁতি প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষ সাহিত্যের বিষয়সভায় উপেক্ষার কারণে স্থানলাভে বঞ্চিত হওয়ায় সাহিত্যের ভুবন আনন্দহীন উষর মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। মরুভূমির সেই উষরতাকে রসে পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য ভবিষ্যতের কবির প্রতি রবীন্দ্রনাথের আহ্বান ।
উদ্বারি - ওপরে বা ঊর্ধ্বে প্রকাশ করে দাও। অন্তরে যে উৎস (এখানে রসের উৎস) রয়েছে, তা উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বোঝানো হয়েছে ।
সাহিত্যের ঐকতান সংগীত সভায় - সাহিত্যে জীবনের সর্বপ্রান্তস্পর্শী সমস্বর বা ঐকতান ।
‘একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়’ - অবজ্ঞাত বা উপেক্ষিত মানুষও যেন সম্মান লাভ করে সে-কথা বলা হয়েছে।
‘মূক যারা দুঃখে সুখে,নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে ’- দুঃখ-সুখ সহ্য করা নির্বাক মানুষ, যারা এগিয়ে চলা পৃথিবীতে এখনো
মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না ।
“ঐকতান” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থের ১০ সংখ্যক কবিতা। কবির মৃত্যুর মাত্র চার মাস আগে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ ‘জন্মদিনে' কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যা ‘প্রবাসী’তে কবিতাটি 'ঐকতান'-নামে প্রথম প্রকাশিত হয়। “ঐকতান” অশীতিপর স্থিতপ্রজ্ঞ কবির আত্ম-সমালোচনা ; কবি হিসেবে নিজের অপূর্ণতার স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকারোক্তি ।
দীর্ঘ জীবন-পরিক্রমণের শেষপ্রান্তে পৌঁছে স্থিতপ্রজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ পেছন ফিরে তাকিয়ে সমগ্র জীবনের সাহিত্যসাধনার সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব খুঁজেছেন “ঐকতান” কবিতায়। তিনি অকপটে নিজের সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতার কথা ব্যক্ত করেছেন এখানে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কবি অনুভব করেছেন নিজের অকিঞ্চিৎকরতা ও ব্যর্থতার স্বরূপ। কবি বুঝতে পেরেছেন, এই পৃথিবীর অনেক কিছুই তাঁর অজানা ও অদেখা রয়ে গিয়েছে। বিশ্বের বিশাল আয়োজনে তাঁর মন জুড়ে ছিল কেবল ছোট একটি কোণ । জ্ঞানের দীনতার কারণেই নানা দেশের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন গ্রন্থের চিত্রময় বর্ণনার বাণী কবি ভিক্ষালব্ধ ধনের মতো সযত্নে আহরণ করে নিজের কাব্যভাণ্ডার পূর্ণ করেছেন। তবু বিপুলা এ পৃথিবীর সর্বত্র তিনি প্রবেশের দ্বার খুঁজে পাননি। চাষি ক্ষেতে হাল চষে, তাঁতি তাঁত বোনে, জেলে জাল ফেলে— এসব শ্রমজীবী মানুষের ওপর ভর করেই জীবনসংসার এগিয়ে চলে। কিন্তু কবি এসব হতদরিদ্র অপাঙ্ক্তেয় মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে সমাজের উচ্চ মঞ্চে আসন গ্রহণ করেছিলেন। সেখানকার সংকীর্ণ জানালা দিয়ে যে জীবন ও জগৎকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তা ছিল খণ্ডিত তথা অপূর্ণ। ক্ষুদ্র জীবনের সঙ্গে বৃহত্তর মানব-জীবনধারার ঐকতান সৃষ্টি না করতে পারলে শিল্পীর গানের পসরা তথা সৃষ্টিসম্ভার যে কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়, কবিতায় এই আত্মোপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বলেছেন, তাঁর কবিতা বিচিত্র পথে অগ্রসর হলেও জীবনের সকল স্তরে পৌছাতে পারেনি। ফলে, জীবন-সায়াহ্নে কবি অনাগত ভবিষ্যতের সেই মৃত্তিকা-সংলগ্ন মহৎ কবিরই আবির্ভাব প্রত্যাশা করেছেন, যিনি শ্রমজীবী মানুষের অংশীদার হয়ে সত্য ও কর্মের মধ্যে সৃষ্টি করবেন আত্মীয়তার বন্ধন। “ঐকতান” কবিতায় যুগপৎ কবির নিজের এবং তাঁর সমকালীন বাংলা কবিতার বিষয়গত সীমাবদ্ধতার দিক উন্মোচিত হয়েছে।
কবিতাটি সমিল প্রবহমান অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। কবিতাটিতে ৮+৬ এবং ৮+১০ মাত্রার পর্বই অধিক। তবে এতে কখনো-কখনো ৯ মাত্রার অসমপর্ব এবং ৩ ও ৪ মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ব্যবহৃত হয়েছে।
বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া,
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর –
আমি চির উন্নত শির! ...
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন !
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
কবি-পরিচিতি
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলা কাব্যজগতের এক অনন্য শিল্পী । তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মাত্র আট বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে কবির পরিবার চরম দারিদ্র্যে পতিত হয় । ১৩১৬ বঙ্গাব্দে গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাইমারি পাস করে সেখানেই এক বছর শিক্ষকতা করেন নজরুল । বারো বছর বয়সে তিনি লেটোর দলে যোগ দেন এবং দলের জন্য পালাগান রচনা করেন । বস্তুত তখন থেকেই তিনি সৃষ্টিশীল সত্তার অধিকারী হয়ে ওঠেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪) শুরু হওয়ার পর ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে তিনি যোগদান করেন এবং করাচিতে যান; পরে হাবিলদার পদে উন্নীত হন ।
১৯২০ সালের শুরুতে বাঙালি পল্টন ভেঙে দিলে তিনি কলকাতায় আসেন এবং পরিপূর্ণভাবে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন । সাপ্তাহিক 'বিজলী'তে “বিদ্রোহী” কবিতা প্রকাশিত হলে চারদিকে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি 'লাঙল', 'নবযুগ', 'ধূমকেতু'-সহ বিভিন্ন পত্র- পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন । তাঁর রচিত বিখ্যাত কাব্যসমূহ : ‘অগ্নি-বীণা', 'বিষের বাঁশি', 'সাম্যবাদী', ‘সর্বহারা', ‘সিন্ধু হিন্দোল’, ‘চক্রবাক', 'সন্ধ্যা', ‘প্রলয়-শিখা' । এছাড়াও তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন । অসংখ্য সংগীতের স্রষ্টা নজরুল । দেশাত্মবোধক গান, শ্যামাসংগীত, গজল রচনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার । ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ' (১৯৬০) উপাধিতে ভূষিত করে । 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক', ‘একুশে পদক'সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হন ।
তারুণ্যকে
সত্যকে
লোকভয়কে
রাজভয়কে
মম- আমার।
দুর্দম - দমন করা শক্ত এমন, দুর্দান্ত, দুরন্ত ।
দুর্বিনীত - অবিনয়ী, উদ্ধত, অশিষ্ট।
নৃশংস - নির্দয়, নিষ্ঠুর, হিংস্র।
পৃথ্বী - পৃথিবী।
দুর্বার - নিবারণ করা বা বাধা দেওয়া শক্ত এমন, দুর্নিবার।
উচ্ছৃঙ্খল - শৃঙ্খলাহীন, শৃঙ্খলাকে অতিক্রান্ত।
শ্মশান – শবদাহের স্থান, মশান।
ভালে - কপালে।
রণতূর্য - রণশিঙ্গা, যুদ্ধঘোষণা বা যুদ্ধযাত্রার সময় যে শিঙ্গা বাজানো হতো।
হুষ্কার - গর্জন, সিংহনাদ ।
ধর্মরাজ - যুধিষ্ঠির, ধর্মঠাকুর।
দাবানল - বনের গাছে গাছে ঘর্ষণের ফলে যে আগুনের সৃষ্টি হয়, বন দহনকারী অগ্নি৷
দাহন - দগ্ধকরণ, পোড়ানো, সন্তাপ সৃষ্টিকারী। -
উন্মন - অন্যমনস্ক, উদাস।
পথবাসী - নিরাশ্রয়, পথে বাস করে এমন
অবমানিত – অবহেলিত, অপমানিত, অসম্মানিত, পরিত্যক্ত ।
মলয় অনিল - মলয় পর্বত থেকে আসা স্নিগ্ধ বাতাস ।
বেণু বীণ - বাঁশ নির্মিত বাদ্যযন্ত্র, বাঁশের বাঁশি।
তিয়াসা - তৃষ্ণা, পিপাসা ।
রৌদ্র রুদ্র রবি - সূর্যের উত্তপ্ত কিরণকে এখানে রৌদ্রদগ্ধ বা রবির ক্রুদ্ধ অবস্থা বোঝানো হয়েছে।
সিন্ধু উতলা - উত্তাল সাগর, ভাবাবেগে আকুল সাগর।
রুষে উঠি - রাগে খেপে উঠি।
নিখিল অখিল - সমগ্র বিশ্ব, সমুদয় সৃষ্টি।
উপাড়ি - উপড়ে ফেলে, উৎপাটিত করে।
ক্রন্দন রোল - কান্নার শব্দ, রোদন ধ্বনি।
রণভূম - যুদ্ধক্ষেত্ৰ ৷
রণক্লান্ত - যুদ্ধে ক্লান্ত, যুদ্ধে অবসন্ন
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত “বিদ্রোহী” কবিতাটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবাণী' (১৯২২) থেকে সংকলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা
"বিদ্রোহী"। "বিদ্রোহী" বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। রবীন্দ্রযুগে এ কবিতার মধ্য দিয়ে এক প্রাতিম্বিক কবিকণ্ঠের আত্মপ্রকাশ ঘটে- যা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিরল স্মরণীয় ঘটনা। “বিদ্রোহী' কবিতায় আত্মজাগরণে উন্মুখ কবির সদয় আত্মপ্রকাশ ঘোষিত হয়েছে। বিদ্রোহী- কাজী নজরুল ইসলাম কবিতায় সগর্বে কবি নিজের বিদ্রোহী কবিসত্তার প্রকাশ ঘটিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের শাসকদের শাসন ক্ষমতার ভিত কাঁপিয়ে দেন। এ কবিতায় সংযুক্ত রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কবির ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। কবি সকল অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে গিয়ে। বিভিন্ন ধর্ম, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পুরাণের শক্তি উৎস থেকে উপকরণ উপাদান সমীকৃত করে নিজের বিদ্রোহী সত্তার অবয়ব রচনা করেন। কবিতার শেষে ধ্বনিত হয় অত্যাচারীর অত্যাচারের অবসান কাম্য। বিদ্রোহী কবি উৎকণ্ঠ ঘোষণায় জানিয়ে দেন যে, উৎপীড়িত জনতার ক্রন্দনরোল যতদিন পর্যন্ত প্রশমিত না হবে ততদিন এই বিদ্রোহী কবিসত্তা শান্ত হবে না। এই চির বিদ্রোহী অভ্রভেদী চির উন্নত শিররূপে বিরাজ করবে!
সাম্যবাদী
কাজী নজরুল ইসলাম | কবি-পরিচিতি : "জীবন-বন্দনা" কবিতা অংশে দ্রষ্টব্য)
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান।।
কে তুমি?- পার্সি? জৈন? ইহুদি? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কনফুসিয়াস্? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বল আরও!
বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে-পিঠে, কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক—
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও যত স, -
কিন্তু কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি? পথে ফোটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান
, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার ।
কেন খুঁজে ফের দেবতা-ঠাকুর মৃত-পুঁথি-কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।
বন্ধু, বলিনি ঝুটি,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট
এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মসৃজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয় ।
এই রণ-ভূমে বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হলো মেষের রাখাল নবিরা খোদার মিতা।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি ।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই ।
কবি-পরিচিতি
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলা কাব্যজগতের এক অনন্য শিল্পী । তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মাত্র আট বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে কবির পরিবার চরম দারিদ্র্যে পতিত হয় । ১৩১৬ বঙ্গাব্দে গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাইমারি পাস করে সেখানেই এক বছর শিক্ষকতা করেন নজরুল । বারো বছর বয়সে তিনি লেটোর দলে যোগ দেন এবং দলের জন্য পালাগান রচনা করেন । বস্তুত তখন থেকেই তিনি সৃষ্টিশীল সত্তার অধিকারী হয়ে ওঠেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪) শুরু হওয়ার পর ১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে তিনি যোগদান করেন এবং করাচিতে যান; পরে হাবিলদার পদে উন্নীত হন ।
১৯২০ সালের শুরুতে বাঙালি পল্টন ভেঙে দিলে তিনি কলকাতায় আসেন এবং পরিপূর্ণভাবে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন । সাপ্তাহিক 'বিজলী'তে “বিদ্রোহী” কবিতা প্রকাশিত হলে চারদিকে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি 'লাঙল', 'নবযুগ', 'ধূমকেতু'-সহ বিভিন্ন পত্র- পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন । তাঁর রচিত বিখ্যাত কাব্যসমূহ : ‘অগ্নি-বীণা', 'বিষের বাঁশি', 'সাম্যবাদী', ‘সর্বহারা', ‘সিন্ধু হিন্দোল’, ‘চক্রবাক', 'সন্ধ্যা', ‘প্রলয়-শিখা' । এছাড়াও তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন । অসংখ্য সংগীতের স্রষ্টা নজরুল । দেশাত্মবোধক গান, শ্যামাসংগীত, গজল রচনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার । ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ' (১৯৬০) উপাধিতে ভূষিত করে । 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক', ‘একুশে পদক'সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হন ।
সাম্য -সমদর্শিতা। সমতা।
সাম্যবাদ - জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার থাকা উচিত এই মতবাদ ।
পার্সি - পারস্যদেশের বা ইরানের নাগরিক ।
জৈন -জিন বা মহাবীর প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতাবলম্বী জাতি।
ইহুদি - প্রাচীন হিব্রু বা জু-জাতি ও ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ। ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম নৃগোষ্ঠীবিশেষ।
গারো - গারো পর্বত অঞ্চলের অধিবাসী । ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীবিশেষ ।
সাঁওতাল, ভীল - ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম নৃগোষ্ঠীবিশেষ।
কনফুসিয়াস - চীনা দার্শনিক । এখানে তাঁর অনুসারীদের বোঝানো হয়েছে ।
চার্বাক - একজন বস্তুবাদী দার্শনিক ও মুনি। তিনি বেদ, আত্মা, পরলোক ইত্যাদিতে আস্থাশীল ছিলেন না ।
জেন্দাবেস্তা - পারস্যের অগ্নি উপাসকদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা এবং তার ভাষা জেন্দা।
সকল শাস্ত্র ..... দেখ নিজ প্রাণ - ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান শরিফ, হিন্দুদের বেদ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বাইবেল-এভাবে পৃথিবীর নানা জাতির নানা ধর্মগ্রন্থ। কবি। এখানে বলতে চেয়েছেন সকল ধর্মগ্রন্থের মূলমন্ত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যেই সংকলিত আছে তা হচ্ছে মানবতাবোধ, সমতার দৃষ্টিভঙ্গি ।
যুগাবতার - বিভিন্ন যুগে অবতীর্ণ মহাপুরুষ বা আবতার ।
দেউল - দেবালয়। মন্দির।
ঝুট - মিথ্যা ।
নীলাচল - জগন্নাথক্ষেত্র নীলবর্ণযুক্ত পাহাড়। যে বিশাল পাহাড়ের পরিসীমা নির্ধারণ করা যায় না।
কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, গয়া - হিন্দুদের ধর্মীয় কয়েকটি পবিত্র স্থান ।
জেরুজালেম - বায়তুল-মোকাদ্দস । ফিলিস্তিনে অবস্থিত এই স্থানটি মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের নিকট সমভাবে পুণ্যস্থান
মসজিদ এই… এই হৃদয় - মানুষের হৃদয়ই মসজিদ, মন্দির গির্জা বা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের মতো পবিত্র
আবদুল কাদির সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত 'নজরুল রচনাবলি'র প্রথম খণ্ড থেকে "সাম্যবাদী” কবিতাটি সংকলন করা হয়েছে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত 'সাম্যবাদী' কাব্যের অন্তর্ভুক্ত এ কবিতাটিতে বৈষম্যবিহীন অসাম্প্রদায়িক মানব সমাজ গঠনের প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে। কবি এই সাম্যের গান' গেয়েই গোটা মানব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে আগ্রহী। কবির বিশ্বাস মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে পরিচিত হয়ে ওঠার চেয়ে সম্মানের আর কিছু হতে পারে না। নজরুলের এই আদর্শ আজও প্রতিটি সত্যিকার মানুষের জীবনপথের প্রেরণা । কিন্তু মানুষ এখনও সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে রাজনীতি করছে, মানুষকে শোষণ করছে, একের বিরুদ্ধে অন্যকে উস্কে দিচ্ছে ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে মানুষকে পরস্পর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে । নজরুল এই কবিতায় সুস্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : “মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর" । তাই তিনি জোর দেন অন্তর-ধর্মের ওপর। ধর্মগ্রন্থ পড়ে যে জ্ঞান মানুষ আহরণ করতে পারে, তাকে যথোপযুক্তভাবে উপলব্ধি করতে হলে প্রয়োজন প্রগাঢ় মানবিকতাবোধ। মানুষের হৃদয়ের চেয়ে যে শ্রেষ্ঠ কোনো তীর্থ নেই, এই প্রতীতি কবির স্বোপার্জিত অনুভব। এ কারণেই কবি মানবিক মেলবন্ধনের এক অপূর্ব সংগীত পরিবেশন করতে আগ্রহী । এ গানে মানুষে মানুষে সব ব্যবধান ঘুচে যাবে । মানবতার সুবাস ছড়ানো আত্মার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এই জীবনকে পবিত্রতম করে তোলা সম্ভব, এই মর্মবাণীকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াই এই কবিতায় নজরুলের অন্বিষ্ট।
এসেছ বন্ধু? তোমার কথাই জাগছিল ভাই প্রাণে,—
কাল রাতে মোর মই প'ড়ে গেছে ক্ষেতভরা পাকা ধানে ।
ধান্যের ঘ্রাণে ভরা আঘ্রানে শুভ নবান্ন আজ,
পাড়ায় পাড়ায় উঠে উৎসব, বন্ধ মাঠের কাজ ।
লেপিয়া আঙিনা দ্যায় আল্পনা ভরা মরাইএর পাশে;
লক্ষ্মী বোধ হয় বাণিজ্য ত্যাজি' এবার নিবসে চাষে ।
এমন বছরে রাতারাতি মোর পাকা ধানে পড়ে মই !
দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসো, সে দুখের কথা কই;
বোশেখ, জ্যষ্টি, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্দর, আশ্বিন,
আশা-আতঙ্কে খেয়াল ছিল না কোথা দিয়ে কাটে দিন ।
দুর্যোগে সবে বালির বাঁধনে বাঁধিনু বন্যাধারা,
বুকের রক্ত জল কোরে কভু সেচিনু পাণ্ডু চারা ।
কার্তিকে দেখি চারিদিকে, একি! এবার ত নহে ফাঁকি!
পাঁচরঙা ধানে ছক-কাটা মাঠ জুড়ায় চাষার আঁখি ।
অঘ্রানে থাকে থাকে
কাটিয়া তোলায় খামারে গোলায় যাহার যেমন পাকে ।
আমি রোজ ভাবি— ফসলটা নাবি, আরও ক'টা দিন যাক,
ভরা অঘ্রানে ঘটেনা ত কোনো দৈব দুর্বিপাক ।
মরাই-সারাই শেষ কোরে, সবে খামারে দিইছি হাত, কালুকে হঠাৎ-
বন্ধু, দোহাই, তুলোনাকো হাই, হইনু অপ্রগল্ভ, -
ক্ষমা করো সখা,— বন্ধ করিনু তুচ্ছ ধানের গল্প ।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার পাতিলপাড়া গ্রামে ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬এ জুন জন্মগ্রহণ করেন। ত পিতার নাম দ্বারকানাথ সেনগুপ্ত । যতীন্দ্রনাথ পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী । দুঃখকেই জীবনের চূড়ান্ত সত্য আর জেনেছিলেন তিনি । মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রমজীবী কৃষিজীবী মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবের সংঘাতকে তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন। কল্পনাবিলাস কিংবা ভাবালুতায় ছিল তাঁর চরম অবিশ্বাস । নতুন ধরনের কবিতা রচনা করে রবীন্দ্রনাথের অনুসারী কবিলেন নতুন দৃষ্টি দিয়ে চারপাশের জগৎকে দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি । তাঁর এই নবীন দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালের আলোর কবিকেই প্রভাবিত করেছিল । বিষয় ও গঠনের দিক থেকে তিনি কবিতাকে ঢেলে সাজাতে আগ্রহী ছিলেন । একেবারে দৈনন্দিন জীবনের নানাকিছু যে শিল্পের সীমা লঙ্ঘন না করেও অনায়াসে কাব্য-বিষয় হতে পারে তার পরিচয় রয়েছে তাঁর কাব্যে । সেইসঙ্গে তাঁর কাব্যে স্থান পেয়েছে গদ্যসুলভ শব্দ ও উপমার অভিনবত্ব। তাঁর কবিতার বক্তব্য যেমন সমকালীন সাহিত্যিকদের চমক লাগিয়েছিল তেমনি তাঁর বলার ভঙ্গি পাঠককে করেছিল মুগ্ধ। যতীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মরীচিকা'। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'মরুশিখা', 'মরুমায়া', 'সায়ম', 'ত্রিযামা', 'নিশান্তিকা' প্রভৃতি। শেষ বয়সে তিনি "হ্যামলেট', 'ম্যাকবেথ', 'ওথেলো', 'কুমারসম্ভব' প্রভৃতি চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ করেছিলেন । তিনি ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ।
নবান্ন - ফসল কাটার উৎসব। গ্রাম-বাংলায় প্রতিবছর হেমন্তকালে ঘরে ফসল তোলার উপলক্ষে নাচ-গানসহ নতুন ধানে তৈরি নানারকম খাবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে পালিত হয় নবান্ন উৎসব ।
মই প'ড়ে গেছে ক্ষেতভরা পাকা ধানে" - পাকা ধানে মই দেওয়া" একটি বাংলা প্রবাদ । এর অর্থ হলো প্রায়সম্পন্ন কোনো কাজ পণ্ড করা। অন্যের ক্ষতি করা। জমিতে মই দেওয়া হয় বীজ বোনা কিংবা চারা লাগানোর আগে; মাটিকে নরম ঝুরঝুরে করার জন্য । কিন্তু যে জমি ফসলে পূর্ণ, যখন ফসল কাটার সময় আসন্ন তখন মই দিলে তো সব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। ক্ষতি বোঝাতে ব্যবহৃত এই প্রবাদটিকে কবি কৌশলে তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন।
আল্পনা - গ্রামে বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে বাড়ির আঙিনায় হাতে আঁকা নকশা। ঐতিহ্যগতভাবে আতপ চাল বেটে তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জল এবং নানারকম রং মিশিয়ে আপনার উপকরণ প্রস্তুত করা হয়। ইদানীং সিনথেটিক রং দিয়েও আল্পনা আঁকা হয় ।
মরাই - হোগলা, বেত ইত্যাদি দিয়ে তৈরি শস্য জমা রাখার বড় আধার।ধানের গোলা।
লক্ষ্মী বোধ হয় বাণিজ্য ত্যাজি এবার নিবসে চাষে - প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে— “বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী"। অর্থাৎ, ব্যবসায়- বাণিজ্যে প্রচুর অর্থলাভ হয় তথা ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আগমন ঘটে । আলোচ্য কবিতায় কবি প্রবাদটিকে পাল্টে দিয়েছেন। কবিতায় বর্ণিত কৃষকের মাঠে এবার এমন ফসল হয়েছে যে, কৃষকের মনে হচ্ছে লক্ষ্মী দেবী এবার বাণিজ্যের পরিবর্তে ফসলের ক্ষেতে বিরাজ করছেন। আর তাই প্রচুর অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা কৃষককে আনন্দ-স্বপ্নে বিভোর করছে।
দাওয়া - ঘরের আঙ্গিনা
বালির বাঁধনে বাঁধিনু বন্যাধারা - বাংলা প্রবাদ "বালির বাধ"কবি শৈল্পিকভাবে এই কবিতায় ব্যবহার করেছেন। “বালির বাঁধ”-এর অর্থ হলো এমন কিছু যা ক্ষণভঙ্গুর বাঁচানোর লক্ষ্যে সকল দুর্যোগ ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে নিজের যথাসাধ্য চেষ্টাকে কাজে লাগিয়েছেন কিন্তু তার সবই বালির বাঁধের মতো শেষ পর্যন্ত বিফলে গেছে।
বুকের রক্ত জল করে কভু সেচিনু পান্ডু চারা - কৃষকের ফসল ফলানোর অপরিহার্য শর্ত হলো পর্যাপ্ত জলসেচের ব্যবস্থা। এদেশের প্রেক্ষাপটে এই সেচ ব্যবস্থাও কখনও হয়ে ওঠে অনিশ্চিত। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বাংলার কৃষক তার ফসলের মাঠ সেচ দিয়ে সজীব রাখে। মলিন মৃতপ্রায় চারাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ শ্রম ঢালে ।
পাণ্ডু - ফ্যাকাশে মলিন।
নাবি - দেরিতে হয় এমন
দুর্বিপাক - বিপদ। দুর্যোগ।
অপ্রগলভ - অচঞ্চল বিনয়ী, আচরণে শালীন।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের "নবান্ন" কবিতাটি তাঁর 'মরুমায়া' গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে । একদিকে বাংলার কৃষকের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনাময় বাস্তবতা এই কবিতায় শিল্প অবয়ব লাভ করেছে; অপরদিকে, 'কৃষক' আর ‘পাকা ধান'-এর প্রতীকে কবির আপন সৃষ্টির ধ্বংস হওয়ার বেদনা দ্যোতিত হয়েছে ।
জনৈক বন্ধুর সঙ্গে কবি তাঁর মনের দুঃখকথা বলে চলেছেন – এমন ভঙ্গি ব্যবহার করে কবিতাটির সূচনা । কবির সেই বেদনা-কাহনে উঠে এসেছে তাঁর ক্ষেতভরা পাকা ধান কীভাবে এক রাতে ধ্বংস হয়ে গেছে সেই কথা। ফসল কাটার সময় সমাগত বিবেচনা করে কৃষক কবির বাড়ি সেজে উঠেছিল আল্পনায়, গোলাঘর মেরামত করে। ধান সংগ্রহের সকল আয়োজন হয়েছিল সম্পন্ন । একদিকে বাড়িতে এতসব আয়োজন আর অন্যদিকে মাঠে ফসল কাটার প্রতীক্ষা । এ যেন বাংলার কৃষক-জীবনের অকৃত্রিম রূপায়ণ কৃষকেরা মাসের পর মাস ধরে রক্ত জল করা শ্রমে চারাগাছ থেকে তিল তিল করে বড় করে তোলে পাকা ধান এই সময় জুড়ে বিভিন্ন প্রকৃতিসৃষ্ট ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের আশঙ্কায় দুলে ওঠে তাদের হৃদয় তবু তারা স্বপ্ন দেখে, বিভোর হয় আসন্ন সুখময় দিনের কল্পনায় । কবিও একইভাবে ধান কাটার অপেক্ষায় দিন গুনেছেন অগ্রহায়ণ মাসে দুর্বিপাক ঘটার শঙ্কা না থাকায় ভেবেছেন ফসলগুলো আরেকটু পরিপক্ক হলে তবে কাটবেন। কিন্তু তার আগেই তাঁর পাকা ধানে মই পড়ে গেছে। কিন্তু মই দেওয়া তো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। তবে কি কবি কারও শত্রুতার শিকার? এই প্রশ্নের উত্তর কবিতায় নেই ৯ এর কারণ অনুসন্ধানের তাগিদ তিনি অনুভব করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কবির দুঃখ শেষ হয় না। কবির এই কষ্টের কথা শোনার ধৈর্যও কারও হয় না। কবির বন্ধুর অসহিষ্ণুতা থামিয়ে দেয় কবিকে। ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার এই অমোঘ বাস্তবতা শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় এক অসমাপ্ত গল্পে। এভাবেই বেদনার রেশ টেনে নবান্নের আনন্দ মুছে দিয়ে সমাপ্ত হয় কবিতাটি।
কবিতাটির একটি প্রতীকী তাৎপর্যও লক্ষণীয়। 'পাকা ধান'-এর প্রতীকে, কৃষকের রূপকল্পে যতীন্দ্রনাথ আপন সৃষ্টিকে আরও নিজের করে পেতে চান। কিন্তু সেই সৃষ্টিকর্ম যখন সমালোচিত হয়, সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। তখন কবি বেদনাহত হন। পাকা ধান নষ্ট হওয়া হৃতসম্বল কৃষকের সঙ্গে নিজের সাদৃশ্য খুঁজে পান তিনি । এভাবে এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যতীন্দ্রনাথ তাঁর অনুভবকে শিল্পায়িত করেছেন আলোচ্য “নবান্ন” কবিতায় ।
কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। এর পর্ব বিভাগ মুখ্যত ৬+৬+৬+২। অর্থাৎ, চরণের শেষে ২ মাত্রার একটি পর্ব বিদ্যমান। অবশ্য কোনো কোনো চরণে এর ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয় ।
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তার ঘর।
আমার এ কূল ভাঙ্গিয়াছে যে বা আমি তার কূল বাঁধি;
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
যে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
মোর বুকে যে বা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল-মালঞ্চ ধরি
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী
আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি, সাজাই নিরন্তর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
জসীমউদ্দীন ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আনসারউদ্দীন মোল্লা এবং মায়ের নাম আমিনা খাতুন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ফরিদপুরের গোবিন্দপুর গ্রামে। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজে অধ্যয়নকালে "কবর" কবিতা রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন এবং ছাত্রাবস্থায়ই কবিতাটি স্কুল পাঠ্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।
জসীমউদ্দীন 'পল্লি-কবি' হিসেবে সমধিক পরিচিত। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন। পরে সরকারের প্রচার ও জনসংযোগ বিভাগে উচ্চপদে আসীন হন। পল্লিজীবন তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য। বাংলার গ্রামীণ জীবনের আবহ, সহজ-সরল প্রাকৃতিক রূপ উপযুক্ত শব্দ উপমা ও চিত্রের মাধ্যমে তাঁর কাব্যে এক অনন্য সাধারণ মাত্রায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর বিখ্যাত 'নকসী কাঁথার মাঠ' কাব্যটি বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় ও সমাদৃত গ্রন্থ হচ্ছে : 'সোজন বাদিয়ার ঘাট', 'বালুচর', 'ধানখেত', 'রঙিলা নায়ের মাঝি'। সাহিত্যকৃতির স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি প্রদান করে।
জসীমউদ্দীন ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
যেবা - যে, যিনি।
বিরাগী - নিস্পৃহ, উদাসীন।
দীঘল রজনী - দীর্ঘ রাত
ঘুম যে হরেছে - নির্ঘুম রাত কাটানোর কথা বলা হয়েছে
বিষে-ভরা বাণ - কটু কথা। হিংসাত্মক ভাষা।
সোহাগ - আদর ভালবাসা।
মালঞ্চ - ফুলের বাগান।
৷নিঠুরিয়া - নিষ্ঠুর নির্দয়।
ঠাই - স্থান। আশ্রয়।
নিরন্তর - নিয়ত। অবিরাম।
'প্রতিদান' কবিতাটি কবি জসীমউদ্দীনের 'বালুচর' কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। এ কবিতায় কবি ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে পরার্থপরতার মধ্যেই যে ব্যক্তির প্রকৃত সুখ ও জীবনের সার্থকতা নিহিত সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সমাজ-সংসারে বিদ্যমান বিভেদ-হিংসা-হানাহানি দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও কবির কণ্ঠে প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার বিপরীতে ব্যক্ত হয়েছে প্রীতিময় এক পরিবেশ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। কেননা ভালোবাসাপূর্ণ মানুষই নির্মাণ করতে পারে সুন্দর, নিরাপদ পৃথিবী। কবি অনিষ্টকারীকে কেবল ক্ষমা করেই নয়, বরং প্রতিদান হিসেবে অনিষ্টকারীর উপকার করার মাধ্যমে পৃথিবীকে সুন্দর, বাসযোগ্য করতে চেয়েছেন।
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,
দেখেছি আমারি হাতে হয়ত নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প'ড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে- এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ:
আধুনিক বাংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। ১৮৯৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি তিনি বরিশালে জন্য গ্রহণ করেন। পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন সেকালের বিখ্যাত কবি। মায়ের কাছ থেকে তিনি কবিতা লেখার প্রেরণা লাভ করেছিলেন। স্বল্প সময়ের জন্য বিভিন্ন পেশা অবলম্বন করলেও মূলত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবেই তিনি জীবন অতিবাহিত করেন। কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতায় সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভবের এক জগৎ তৈরি করেন। বিশেষ করে গ্রামবাংলার নিসর্গের যে ছবি তিনি এঁকেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা চলে না। সেই নিসর্গের সঙ্গে অনুভব ও বোধের বহুতর মাত্রা যুক্ত হয়ে তাঁর হাতে অনন্যসাধারণ কবিতাশিল্প রচিত হয়েছে। এই অসাধারণ কাব্যবৈশিষ্ট্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "চিত্ররূপময়" বলে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া ব্যক্তিমানুষের নিঃসঙ্গতা, আধুনিক জীবনের বিচিত্র যন্ত্রণা ও হাহাকার এবং সর্বোপরি জীবন ও জগতের রহস্য ও মাহাত্ম্য সন্ধানে তিনি এক অপ্রতিম কবিভাষা সৃষ্টি করেছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন 'নির্জনতম কবি' বলে। উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক সৃজন, আলো-আঁধারের ব্যবহার, রঙের ব্যবহার এবং অনুভবের বিচিত্র মাত্রার ব্যবহারে তাঁর কবিতা লাভ করেছে অসাধারণত্ব। তাঁর নিসর্গবিষয়ক কবিতা বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিশেষ স্থান রয়েছে। জীবনানন্দের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক', 'ধূসর পাণ্ডুলিপি', 'বনলতা সেন', 'মহাপৃথিবী', 'বেলা অবেলা কালবেলা', 'রূপসী বাংলা'। 'কবিতার কথা' তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ এবং 'মাল্যবান' ও 'সুতীর্থ' তাঁর বিখ্যাত দুইটি উপন্যাস ।
জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে অক্টোবর কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
সুচেতনা.... নির্জনতা আছে - সুচেতনা নামে এক শুভ চেতনার কথাই এখানে বোঝানো হয়েছে। কবির কল্পনায় দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন এই চেতনার সবুজে বিরাজ করছে নির্জনতা। অর্থাৎ এই শুভ চেতনা সর্বত্র বিস্তারিত, বিরাজমান নয়।
এই পৃথিবীর..... সত্য নয় - সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি বহু যুদ্ধ-রক্তপাত প্রাণহানী সংঘটিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তবে এই ধ্বংসাত্মক দিকটিই পৃথিবীর শেষ সত্য নয় ।
আজকে অনেক.....পরিজন পড়ে আছে - প্রেম, সত্য ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও পৃথিবীতে অগণিত প্রাণহানি, রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ অনেক
রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়েই পৌঁছাতে হয় ভালোবাসার পরিণামে।
এই পথে আলো.... ক্রমমুক্তি হবে - পৃথিবীব্যাপ্ত গভীর অসুখ বা বিপর্যয় থেকে মুক্তির পথই শুভচেতনা। ইতিবাচক এ চেতনার আলো প্রজ্বলনের মাধ্যমেই সকল বিপর্যয় থেকে পৃথিবী ও মানুষের মুক্তি ঘটবে। -
মাটি পৃথিবীর টানে... সব বুঝেছি - ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সংকট প্রত্যক্ষ করে পৃথিবীতে মানবরূপে জন্ম না নেওয়াকে আপাতভাবে কাঙ্ক্ষিত মনে হলেও এই পৃথিবী ও শুভ চেতনা থেকে প্রাপ্তিই শেখাবধি আমাদের গভীরভাবে প্রাণিত ও ঋণী করে।
শাশ্বত রাত্রির..... অনন্ত সূর্যোদয় - পৃথিবীর অন্ধকার বা অশুভের অন্তরালেই আছে সূর্যোদয়, মুক্তির দিশা। সুচেতনার বিকাশেই এই আলোক জ্বাল পৃথিবীর দেখা মিলবে, এটিই কবির বিশ্বাস।
"সুচেতনা" কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন (১৯৪২) কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। “সুচেতনা" জীবনানন্দ দাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। এ কবিতায় সুচেতনা সম্বোধনে কবি তাঁর প্রার্থিত, আরাধ্য এক চেতনানিহিত বিশ্বাসকে শিল্পিত করেছেন। কবির বিশ্বাসমতে, সুচেতনা দূরতম দ্বীপসদৃশ একটি ধারণা, যা পৃথিবীর নির্জনতায়, যুদ্ধে, রক্তে নিঃশেষিত নয়। চেতনাগত এই সত্তা বর্তমান পৃথিবীর গভীরতর ব্যাধিকে অতিক্রম করে সুস্থ ইহলৌকিক পৃথিবীর মানুষকে জীবন্ময় করে রাখে। জীবমুক্তির এই চেতনাগত সত্যই পৃথিবীর ক্রমমুক্তির আলোকে প্রজ্বলিত রাখবে, মানবসমাজের অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করবে। শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সূর্যোদয়কে প্রকাশ করবে।
“হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”
“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম, “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান? ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই, রাখি নি সন্ধান।”
কহিলাম, “ওগো কবি! রচিয়া লহ না আজও গীতি, বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি- এ মোর মিনতি ।”
কহিল সে মৃদু মধু-স্বরে-
“নাই হলো, না হোক এবারে-
আমারে গাহিতে গান, বসন্তেরে আনিতে বরিয়া-
রহেনি, সে ভুলেনি তো, এসেছে তা ফাগুনে স্মরিয়া।”
কহিলাম : “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই? যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
"বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটেনি শাখে? পুষ্পারতি লভেনি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নাই অর্ঘ্য বিরচন?”
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম, “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরে আসি -
“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে ।”
সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের বিশিষ্ট মহিলা কবি ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ২০এ জুন বরিশালে । তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায় । কবির পিতার নাম সৈয়দ আবদুল বারী এবং মায়ের নাম সাবেরা বেগম । যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙালি মুসলমান নারীদের কাটাতে হতো গৃহবন্দি জীবন । স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিল না। ওই বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। পারিবারিক নানা উত্থান পতনের মধ্যে তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন । তারই মধ্যে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন । পরবর্তীকালে সাহিত্য সাধনা ও নারী আন্দোলনে ব্রতী হয়ে তিনি শুধু কবি হিসেবেই বরণীয় হননি, জননী সম্ভাষণে ভূষিত হয়েছেন ।
সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে : “সাঁঝের মায়া', 'মায়া কাজল', 'কেয়ার কাঁটা', ‘উদাত্ত পৃথিবী' ইত্যাদি । এছাড়াও তিনি গল্প, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা লিখেছেন । বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি ।
সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০এ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন
হে কবি - কবিভক্ত এখানে কবিকে সম্বোধন করেছেন ।
নীরব কেন - উদাসীন হয়ে আছেন কেন? কেন কাব্য ও গান রচনায় সক্রিয় হচ্ছেন না।
ফাল্গুন যে এসেছে ধরায় - পৃথিবীতে ফাল্গুন অর্থাৎ বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে।
তব বন্দনায় - তোমার রচিত বন্দনা-গানের সাহায্যে । অর্থাৎ বন্দনা-গান রচনা করে বসন্তকে কি তুমি বরণ করে নেবে না?
দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি? - কবির জিজ্ঞাসা- বসন্তের দখিনা বাতাস বইতে শুরু করেছে কি না। উদাসীন কবি যে তা লক্ষ করেননি তার এই জিজ্ঞাসা থেকে তা স্পষ্ট হয়।
বাতাবি নেবুর ফুল…অধীর আকুল - বসন্তের আগমনে বাতাবি লেবুর ফুল ও আমের মুকুলের গন্ধে দখিনা বাতাস দিগ্বিদিক সুগন্ধে ভরে তোলে। কিন্তু উন্মনা কবি এসব কিছুই লক্ষ করেননি। কবির জিজ্ঞাসা তাঁর উদাসীনতাকেই স্পষ্ট করে।
এখনো দেখনি তুমি? - কবিভক্তের এ কথায় আমরা নিশ্চিত হই প্রকৃতিতে বসন্তের সব লক্ষণ মূর্ত হয়ে উঠেছে। অথচ কবি তা লক্ষ করছেন না ।
কোথা তব নব পুষ্পসাজ - বসন্ত এসেছে অথচ কবি নতুন ফুলে ঘর সাজাননি । নিজেও ফুলের অলংকারে সাজেননি ।
বসন্তেরে আনিতে.... ফাল্গুন স্মরিয়া - কবি বন্দনা-গান রচনা করে বসন্তকে বর্ণনা করলেও বসন্ত অপেক্ষা করেনি। ফাল্গুন আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে।
করিলে বৃথাই - ব্যর্থ করলে অর্থাৎ কবি-ভক্তের অনুযোগ-বসন্তকে কবি বরণ না করায় বসন্তের আবেদন গুরুত্ব হারিয়েছে 1
পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন? - ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ ও বন্দনা করার জন্য গাছে গাছে ফুল ফোটেনি? অর্থাৎ বসন্তকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই যেন ফুল ফোটে ।
অর্ঘ্য বিরচন - অঞ্জলি বা উপহার রচনা । প্রকৃতি বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে ফুল ও তার সৌরভ উপহার দিয়ে বসন্তকে বরণ করে।
উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা - কবিভক্ত বুঝতে পারছেন না, কবি যথারীতি সানন্দে বসন্ত বন্দনা না করে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন কেন ।
কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী - কবি শীতকে মাঘের সন্ন্যাসীরূপে কল্পনা করেছেন। যে সন্ন্যাসী কুয়াশার চাদর পরিধান করে আছে ।
পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে - শীত প্রকৃতিতে দেয় রিক্ততার রূপ গাছের পাতা যায় ঝরে । গাছ হয় ফুলহীন । শীতের এ রূপকে বসন্তের বিপরীতে স্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতি বসন্তের আগমনে ফুলের সাজে সাজলেও কবির মন জুড়ে আছে শীতের রিক্ততার ছবি । শীত যেন সর্বরিক্ত সন্ন্যাসীর মতো কুয়াশার চাদর গায়ে পত্রপুষ্পহীন দিগন্তের পথে চলে গেছে ।
“তাহারেই পড়ে মনে” কবিতাটি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাসিক মোহাম্মদী' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । এ কবিতায় প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাৎপর্যময় অভিব্যক্তি পেয়েছে । সাধারণভাবে প্রকৃতির- সৌন্দর্য মানবমনের অফুরন্ত আনন্দের উৎস। বস্তুত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যে কবিমনে আনন্দের শিহরণ জাগাবে এবং তিনি তাকে ভাবে ছন্দে সুরে ফুটিয়ে তুলবেন সেটাই প্রত্যাশিত কিন্তু কবিমন যদি কোনো কারণে ক শোকাচ্ছন্ন কিংবা বেদনা-ভারাতুর থাকে তবে বসন্ত তার সমস্ত সৌন্দর্য সত্ত্বেও কবির অন্তরকে স্পর্শ করতে পারবে না।
এ কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের দুঃখময় ঘটনার ছায়াপাত ঘটেছে। তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে (১৯৩২) কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসে । তাঁর ব্যক্তিজীবন ও কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে নেমে আসে এক দুঃসহ বিষণ্ণতা। কবিমন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার হাহাকারে । “তাহারেই পড়ে মনে” কবিতাকে আচ্ছন্ন করে আছে এই বিষাদময় রিক্ততার সুর । তাই বসন্ত এলেও উদাসীন কবির অন্তর জুড়ে রিক্ত শীতের করুণ বিদায়ের বেদনা ।
কবিতাটির আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর নাটকীয়তা । গঠনরীতির দিক থেকে এটি সংলাপনির্ভর রচনা কবিতার আবেগময় ভাববস্তুর বেদনাঘন বিষণ্ণতার সুর এবং সুললিত ছন্দ এতই মাধুর্যমণ্ডিত যে তা সহজেই পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায় ।
আমাকে সেই অস্ত্র ফিরিয়ে দাও
সভ্যতার সেই প্রতিশ্রুতি
সেই অমোঘ অনন্য অস্ত্র
আমাকে ফিরিয়ে দাও ।
সেই অস্ত্র আমাকে ফিরিয়ে দাও
যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
পৃথিবীর যাবতীয় অস্ত্র হবে আনত
যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
অরণ্য হবে আরও সবুজ
নদী আরও কল্লোলিত
পাখিরা নীড়ে ঘুমোবে ।
যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
ফসলের মাঠে আগুন জ্বলবে না
খাঁ খাঁ করবে না গৃহস্থালি ।
সেই অস্ত্র আমাকের ফিরিয়ে দাও
যে অস্ত্র ব্যাপ্ত হলে
নক্ষত্রখচিত আকাশ থেকে আগুন ঝরবে না।
মানব বসতির বুকে
মুহূর্তের অগ্ন্যুৎপাত
লক্ষ লক্ষ মানুষকে করবে না পঙ্গু-বিকৃত
আমাদের চেতনা জুড়ে তারা করবে না আর্তনাদ
সেই অস্ত্র যে অস্ত্র উত্তোলিত হলে
বার বার বিধ্বস্ত হবে না ট্রয়নগরী ।
আমি সেই অবিনাশী অস্ত্রের প্রত্যাশী
যে ঘৃণা বিদ্বেষ অহংকার
এবং জাত্যভিমানকে করে বার বার পরাজিত ।
যে অস্ত্র আধিপত্যের লোভকে করে নিশ্চিহ্ন
যে অস্ত্র মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে না
করে সমাবিষ্ট
সেই অমোঘ অস্ত্র-ভালোবাসা
পৃথিবীতে ব্যাপ্ত করো ।
অনেক ঘূর্ণিতে ঘুরে, পেয়ে চের সমুদ্রের স্বাদ,
জীবনের পথে পথে অভিজ্ঞতা কুড়ায়ে প্রচুর
কেঁপেছে তোমাকে দেখে জলদস্যু- দুরন্ত হার্মাদ
তোমার তরঙ্গভঙ্গে বর্ণ তার হয়েছে পাণ্ডুর।
সংগ্রামী মানুষ তবু দুই তীরে চালায়ে লাঙল
কঠিন শ্রমের ফল শস্য দানা পেয়েছে প্রচুর;
উর্বর তোমার চরে ফলায়েছে পর্যাপ্ত ফসল
জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বে নিঃসংশয়, নির্ভীক জওয়ান
সবুজের সমারোহে জীবনের পেয়েছে সম্বল।
বর্ষায় তোমার স্রোতে গেছে ভেসে সাজানো বাগান,
অসংখ্য জীবন, আর জীবনের অজস্র সম্ভার,
হে নদী! জেগেছে তবু পরিপূর্ণ আহ্বান,
মৃত জড়তার বুকে খুলেছে মুক্তির স্বর্ণবার
তোমার সুতীব্র গতি। তোমার প্রদীপ্ত স্রোতধারা ॥
শাখে শাখে চৈত্রের পল্লবে
দেখেছি বিমুগ্ধ চোখে সবুজের বর্ণ সমারোহ;
সে-বর্ণের কিছু আছে রহস্য জটিল
কিছু আছে অন্তরের কথা ।
পত্রঝরা শাখা-বৃত্ত-প্রাণে
কী অব্যক্ত অঅনুনয় ছিল,
রুক্ষ শাখা ঊর্ধ্বশূন্যে কি কথা শোনালো,
উচ্ছ্বসিত বেদনার প্রাণস্পন্দ নিয়ে
কোথা থেকে এলো এই সবুজের শিশু,
তার কিছু ইতিহাস অদৃশ্য অক্ষরে আছে লেখা ।
সে-দুয়ে নীরব কাহিনি
রাত্রিদিন বারবার করে
শুনতে চেয়েছি আমি উন্মুখ শ্রবণে ।
শোনার অতীত যত কথা
দেখার অতীত যত অপ্রতিম রূপ
তাই দিয়ে রূপে-রসে সৃষ্টির নিভৃত মর্মবাণী
লিপিবদ্ধ আছে সঙ্গোপনে ।
সে-রূপের কিছু আলো পেয়েছি হৃদয়ে
কিছু কথা শুনেছি কখনো
মর্মের শ্রবণে
বুঝিনি অনেক কিছু তার ।
যেটুকু বুঝেছি তাও কথা নেই শোনাবার মতো
-তবু সেই সুনিশ্চিত বাণী
অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো অনুভূতি ঘিরে
স্পর্শ তার রেখে যায়, প্রলোভন রেখে যায় আরও,
আমি তাকে পাইনি আমার
চেতনার সহজ সন্ধানে ।
তবু তাকে দেখবার বুঝবার অশেষ বিস্ময়ে
রুদ্ধদ্বার হৃদয়ের কাছে
অনুনয় করি বারংবার :
আলো চাই— আরও আলো, অন্তরের, তীব্রতম আলো ।
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি ।
[ আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা ।
এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে ।
(আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর) *
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা ।
আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিকমতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ ।
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো
তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে ।
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়—
দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে ৷৷
আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে । কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়,
ওরা শহিদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর ।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রংকে
এ-রঙের বিপরীত আছে অন্য রং,
যে-রং লাগে না ভালো চোখে, যে-রং সন্ত্রাস আনে
প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে সকাল-সন্ধ্যায়-
এখন সে রঙে ছেয়ে গেছে পথ-ঘাট, সারা দেশ
ঘাতকের অশুভ আস্তানা ।
আমি আর আমার মতোই বহু লোক
রাত্রি-দিন ভূলুণ্ঠিত ঘাতকের আস্তানায়, কেউ মরা, আধমরা কেউ,
কেউ বা ভীষণ জেদি, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া । চতুর্দিকে
মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ
বুঝি তাই উনিশশো উনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের চোখ আজ আলোচিত ঢাকা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা ।
দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই
জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো মতো *
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা |
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায় । সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ,
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায় । [সংক্ষেপিত]
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম ৷৷
বর্ষা যখন হইত গাজির গাইন আইত
রঙ্গে-ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম
বাউলা গান ঘাটুগান আনন্দের তুফান
গাইয়া সারিগান নাও দৌড়াইতাম ৷৷
হিন্দু বাড়িন্ত যাত্রাগান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার কে হবে গ্রামসরকার
আমরা কি তার খবর লইতাম ৷৷
বিবাদ ঘটিলে পঞ্চাইতের বলে
গরিব কাঙালে বিচার পাইতাম
মানুষ ছিল সরল ছিল ধর্মবল
এখন সবাই পাগল-বড়লোক হইতাম ৷৷
করি ভাবনা সেদিন আর পাব না
ছিল বাসনা সুখী হইতাম
দিন হতে দিন আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম ৷৷
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি ।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল /
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন ।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা ।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে ।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে ।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি ।
উনোনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি ।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না ।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি ।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি ।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায় / *
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মায়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি ।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না ।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না ।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃৎপিণ্ডে ধরে রাখতে পারে না ।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি ।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন ।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মৎস্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে ।
যে লৌহখণ্ডকে প্রজ্বলিত করে ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে ।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি ।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি ।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি ।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা ।
আমরা কি তাঁর মতো কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো ।
[সংক্ষেপিত]
এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায় ।
হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল
রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল
নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে, দুঃখভোলানিয়া গান গায় ।
মোছাব তোমার মুখ আজ সেই গাঢ় পতাকায় ।
ক্রুর পদাতিক যত যুগে যুগে
উদ্ধত পায়ের দাগ রেখে গেছে কোমল পলির ত্বকে
বিভিন্ন মুখের কোটি অশ্বারোহী এসে
খুরে খুরে ক্ষতময় করে গেছে সহনীয়া মাটি,
লালসার লালামাখা ক্রোধে বন্দুক কামান কত
অসুর গর্জনে চিরেছে আকাশ পরিপাটি,
বিদীর্ণ বুক নীল বর্ণ হয়ে গেছ তুমি, বাংলাভূমি
নত হয়ে গেছে মুখ ক্ষোভে ও লজ্জায় ।
এবার মোছাব সেই মুখ শোকাক্রান্ত, তোমার আপন পতাকায়
কে আসে সঙ্গে দেখ দেখ চেয়ে আজ :
কারখানার রাজা, লাঙ্গলের নাবিক,
উত্তাল ঢেউয়ের উদ্যত বৈঠা হাতে মাখা দল
এবং কামার কুমোর তাঁতি এরাতো সবাই সেই
মেহনতের প্রভু, আনুগত্যে
শানিত রক্তে ঢল হয়ে যায় বয়ে তোমার শিরাময় সারা পথে পথে ।
দুহাতে সরায় দ্রুত শহরের জটিল পঙ্কিল,
মধ্যবিত্ত অনড় আবিল । একে একে সকলকে নামায় মিছিলে ।
ডাকে আপামর ভাই বোন । একসাথে মিলে নিশ্ছিদ্র
বিশাল শিলাদৃঢ় পাহাড় বানায় ।
সেই কোটি হাত এক হাত হয়ে
মোছাবে তোমার মুখ তোমার আপন পতাকায় ।
সমস্ত শূন্যতায় আজ বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে যায়
আকাশ চাঁদোয়া জ্বলে রাহুমুক্ত ঘন নীলিমায় ।
অকলুষ বাংলাভূমি হয়ে ওঠো রাতারাতি আদিগন্ত তীর্থভূমি
অন্তহীন মিছিলের দেশ,
সারি সারি মানুষের আকারে হলে মূর্তিময়ী
সমস্ত স্বদেশ আজ রাঙা রাজপথে ।
দিবালোক হয়ে ফোটে প্রাঞ্জল বিপ্লব
সাত কোটি মুখ হাসে মৃত্যুর রঙিন তীর হাতে নিয়ে ।
শ্রেণিবদ্ধ এই ভিড়ে সকলেই সবার আগে
একবার শত্রুকে শেষ দেখা দেখে নিতে চায় ।
দুঃসাহস চমকায় বরাভয় হিল্লোলিত তোমার আপন পতাকায় ॥
তুমি আছো কাজল দিঘির পাড়ে, কোকিলের মধুক্ষরা স্বরে,
হরিৎস্বপ্নে ফুলে-ওঠা প্রান্তরের উর্বর আদরে
সিংহপ্রাণ গিরিবর্থে এবং বঙ্গোপসাগর
নামক আকুল ঐ অস্থিরতার তুমুল গভীরে
আছো দিন-রাত্রি অগ্নিমুখ অশনির অশেষ অধীরে ।
তুমি আছো আজো, ছিলে চিরকাল ।
বিশ্বের সেরা সুন্দরী বলে লুটেছ প্রবাদের খ্যাতি
যদিও রত্নখচা তোমার সৌন্দর্য সেই অবিরত তোমারই হয়েছে কাল ।
তোমাকে মুঠোতে ভরে আনন্দের ঝুমঝুমি
বাজাতে এসেছে যারা
সুকালের ভোজসভার ক্ষুধার্ত অতিথি
রক্ত নিয়ে মুখে ধিক্কারে ধিক্কারে পলাতক তারা,
আবহমান বাংলার বর্বরতম দখলদারও দেখ আজ
কুৎসিততম আঁধারে নির্ঘাৎ হবে লীন ।
তুমি ছিলে অমলিন, আজো আছ অমলিন ।
শত কোটি লাঞ্ছনার তিক্ত দাগ সারা দেহে সয়ে
আজো তুমি মাতা, শুচিশুদ্ধ মাতা সাত কোটি সংশপ্তক
সন্তানের অকাতর তুমি মাতা ।
প্রেম অবারিত হবে বিজয়ের ধারাজলে, রৌদ্র, জোছনায় ।
শত শতাব্দীর অবগুণ্ঠিত আশা পূর্ণ করে-
জীব মোছাব তোমায় মুখ তোমারই আপন পতাকায় ৷৷
লাল পলাশের ভস্মস্তূপে কিসের জ্বালা
স্তব্ধ অধীর বজ্রগর্ভ মেঘের মতো?
শিবির-সীমায় মনের ছায়ায় ইতস্তত
ছড়ায় সে তার কূট-মন্ত্রণা ঘৃণায় ঢালা
দুই শতকের সেই একদিন মনে কি পড়ে?
মিরজাফরের গুলির শিখায়, সমুদ্ধত
নিভলো তোমার দিনের সূর্য দিগন্তরে
দূর গোধূলির সেই একদিন মনে কি পড়ে
মনে কি পড়ে?
নিভলো তোমার ঘরের প্রদীপ পথের বাতি
নিভলো সহসা মহাশূন্যের লক্ষ তারা
কালো রাত্রির যাত্রিক হলে, লক্ষ্যহারা
সড়কে সড়কে ঝড়-ঝঞ্ঝাই তোমার সাথি ।
সমুখে কোথাও এমন সে দেশ আছে কি ভাই
যেখানে আলোর সম্ভারে হাসে বসুন্ধরা?
স্বদেশ আমার চক্র-রাতের মুঠোয় ভরা
গ্রাম জনপদ কাঁপে বর্গীর অশ্বখুরে
সোনার শস্য পোড়ে ছারখার; দৃষ্টি পুড়ে
হলো সঙ্গীন, তাই নেই আর অশ্রুঝরা
টোটায় ঝরে
অযুত প্রাণের অগ্নিশিখার সূর্য-কুঁড়ি
ফৌজের হাঁকে কাঁপে থরথর দস্যুপুরী
'নিমেষে ছড়ায় তারই আওয়াজ দিগন্তরে
মনে কি পড়ে?
রক্ত ঝরে
মতো বাঁশের কেল্লা বেদির পরে
রক্ত ঝরাই ফাঁসির মঞ্চে দ্বীপান্তরে
ঝরেছে সকল রক্ত । এখন কখানা হাড়ে
ঝকঝক করে তীব্র তীক্ষ্ণ বর্ণা-ফলা
নতুন দস্যু আসে যদি, দেশ দেবোনা তারে
ইস্পাত-হাড়ে গড়েছি বজ্ৰ বহ্নি-জ্বালা ৷৷
নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর
নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে উনসত্তর হাজার ।
ধবল দুধের মতো জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ-পূর্ণিমার ।
নষ্ট ক্ষেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার
তখন হঠাৎ কেন দেখা দেয় নিলক্ষার নীলে তীব্র শিস
দিয়ে এত বড় চাঁদ?
অতি অকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি? কোন শব্দ? কিসের প্রপাত ?
গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হয়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে ।
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মানুষের বন্ধ দরোজায় ।
এই তীব্র স্বচ্ছ পূর্ণিমায়
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় ।
কালঘুম যখন বাংলায়
তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আবার নূরলদীন দেখা দেয় মরা আঙিনায় ।
নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল,
রংপুরে নূরলদীন ডাক দিয়েছিল
১১৮৯ সনে ।
আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায় ।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে ।
নূরলদীনেরও কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ি ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, “জাগো, বাহে, কোনঠে সবায় ?”
আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান ।
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো মনোহারী স্পট আমাদের নেই,
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না- আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে-পড়া ডলার মার্ক কিংবা স্টার্লিংয়ের বিনিময়ে যা পাবেন
ডাল্লাস অথবা মেম্ফিস অথবা কালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ!
আসুন, ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোনো শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কি?
অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্যে ব্যবহৃত সব উপকরণ অকৃত্রিম;
আপনাকে আরও খুলে বলি : এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ,
এবং আমি যার পর্যটন দফতরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করে
সম্প্রতি সাজানো হয়েছে :
খাঁটি আর্যবংশ সম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ ন'টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি ।
এখনো অনেক জায়গায় রং কাঁচা- কিন্তু কী আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যান গগ্—যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন— কখনো, শপথ করে বলতে পারি, এমন গাঢ়তা দ্যাখেন নি :
আর দেখুন, এই যে নরমুণ্ডের ক্রমাগত ব্যবহার-- ওর ভেতরেও
একটা গভীর সাজেশান আছে— আসলে ওটাই এই ছবির— অর্থাৎ এই ছবির মতো দেশের - থিম!
নদীর ধসের নিচে
বাতাসের মধ্যে আছে
কিছুটা আশ্রয়;
গানের বদলে পাখি চুপিসারে কথা বলে
শঙ্খের পরিভাষা শিখে,
ঢেউ হয়ে গেছে বালুময় ।
ভেসে যাওয়া ডালপালা কুড়িয়ে কাড়িয়ে
আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে বসে আছে
ভূমিহীন কৃষিজীবী, ইচ্ছে তার
জেলে হয়ে কিছু মাছ ধরে ।
কোনো কোনো দিন যখন জলের তোড়
পাড় ভেঙে ঢুকে পড়ে ক্ষেতের উজানে ফাটলে,
দলিত ঘাস ফসলের শোভা ঠোঁটে
আবার সে ফিরে যায় কাদায় অক্ষর এঁকে দিয়ে;
তখন সে মাছ খোঁজে কাদাখোঁচা পাখির মতন ।
সব মাঠ, হলুদ সবুজ কালো ফসলের সব মাঠ,
সময়ের প্রতীক্ষায় থাকে শুধু ।
কখন মেঘের রঙ সাদা থেকে কালো হবে,
জমে উঠবে মেঘের পাহাড় কখন ক্ষেতের কাজ শুরু হবে কৃষকের
সময়ের প্রতীক্ষায় থাকা শুধু ।
লাঙল নিড়ানি রেখে এখন কেবল
কোঁচ হাতে গোঁজ হয়ে মাছরাঙা গামছা পরে
একঠ্যাঙা বগের মতন চেয়ে থাকে ।
মাটির টিলার পরে তার ঘরে
ঢিলাঢালা ফতুয়ার মধ্যে বসে
মাছভাত খেতে খেতে একদিন
আকালের গল্পকথা বলাবলি করবে তার স্বজনের সাথে
এই স্বপ্ন চোখে নিয়ে
প্রতীক্ষায় থাকা শুধু
মাছরাঙা গামছা পরে একঠ্যাঙা বগের মতন ।
চোখের লবণ জমে চোখ জ্বলে
শুধু জ্বলে । কোঁচ হাতে গোঁজ হয়ে
সময়ের প্রতীক্ষায় থাকা শুধু ।
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত।
হতাশার মতোন হঠাৎ দারুন হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে, শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম।
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়।
লাইলী মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়।
নাহার কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত যেতে পারে না। আর আমি এদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
ওরে মন কান্না কেন? যন্ত্রণায় কেন জর্জরিত?
মৃত্যুর পাষাণ বুকে প্রার্থনার বাণী ব্যর্থ হয়ে
অবিশ্রান্ত ফিরে আসে চলে কাল নির্লিপ্ত নিৰ্ভয়ে।
তুমি কি জানো না মন আমরা কালের হাতে ধৃত?
বুঝি তাই মৃত্যু তার অন্য এক অর্থ নিয়ে আসে:
অনির্বাণ দীপ্তি যার অমৃতের পুত্রদের পথে
সমস্ত যন্ত্রণা মুছে বহমান দুর্নিবার শোতে,
সেই স্বপ্নে তারাফুল ঝরে পড়ে মৃত্তিকার ঘাসে।
যে পথে গিয়েছে তারা কালিদাস, দান্তে ও হোমার
অজেয় রবীন্দ্রনাথ, বেদব্যাস, খৈয়াম, হাফিজ,
সুকান্ত-মিন্টন-শেলী অকাতরে ঢেলে মনসিজ
সেই পথে গেছে সেও। এই শান্তি আমার তোমার।
হে মন প্রফুল্ল হও। শোনো তার মৃত্যুহীন গান
মানুষ সকল সত্য। এই সত্যে আমি অনির্বাণ ।
একটি আংটির মতো তোমাকে পরেছি স্বদেশ
আমার কনিষ্ঠ আঙুলে, কখনও উদ্ধত তলোয়ারের মতো
দীপ্তিমান ঘাসের বিস্তারে, দেখেছি তোমার ডোর কাটা
জ্বলজ্বলে রূপ জ্যোৎস্নায় । তারপর তোমার উন্মুক্ত প্রান্তরে
কাতারে কাতারে কত অচেনা শিবির, কুচকাওয়াজের ধ্বনি,
যার আড়ালে তুমি অবিচল, অটুট, চিরকাল ।
যদিও বধ্যভূমি হলো সারাদেশ— রক্তপাতে আর্তনাদে
হঠাৎ হত্যায় ভরে গেল বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তর,
অথচ সেই প্রান্তরেই একদা ধাবমান জেব্রার মতো
জীবনানন্দের নরম শরীর ছুঁয়ে ঊর্ধ্বশ্বাস বাতাস বয়েছে ।
এখন সেই বাতাসে শুধু ঝলসে যাওয়া স্বজনের
রক্তমাংসের ঘ্রাণ এবং ঘরে ফিরবার ব্যাকুল প্ররোচনা ।
শৃঙ্খলিত বিদেশির পতাকার নিচে এতকাল ছিল যারা
জড়োসড়ো, মগজের কুণ্ডলীকৃত মেঘে পিস্তলের প্রোজ্জ্বল আদল
শীতরাতে এনেছিল ধমনীতে অন্য এক আকাঙ্ক্ষার তাপ
আবাল্য তোমার যে নিসর্গ ছিল নিদারুণ নির্বিকার,
সুরক্ষিত দুর্গের মতন আমাদের প্রতিরোধে সে হলো সহায়,
ব্ল্যাক-আউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে
বিদ্রোহী পূর্ণিমা । আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি;
আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হয়ে
নিজেদের ঘরে ।
শহীদ কাদরী ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম খালেদ-ইবনে-আহমদ কাদরী । শহীদ কাদরী গত শতকের ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস-জীবন যাপন করছেন । সেখানে তিনি একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন ।
সুগভীর মননের অধিকারী শহীদ কাদরীর মূল প্রবণতা বৈশ্বিক বোধকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার আশ্রয়ে কবিতায় প্রকাশযোগ্য করে তোলা। বিশেষ করে ষাটের দশকের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে র্বৈাপার্জিত বোধকে প্রকাশ করার উপায় হিসেবে তিনি রূপক-প্রতীকের আড়ালকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন । প্রকরণগত স্বাতন্ত্র্য শহীদ কাদরীর কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। কবিতায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন । তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : 'উত্তরাধিকার' (১৯৬৭), 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' (১৯৭৪), 'কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই' (১৯৭৮) প্রভৃতি ।
মানসী
শেষের কবিতা
পুনশ্চ
শেষ লেখা
ব্ল্যাক-আউট - নিষ্প্রদীপ। আলো বাইরে আনতে না দেওয়া। সাধারণত যুদ্ধ কিংবা জরুরি অবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট এলাকা অন্ধকারে ঢেকে দেওয়ার কৌশল ।
উদ্ধত তলোয়ারের মতো দীপ্তিমান ঘাসের বিস্তার- স্বদেশের প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ যে ঘাস, কবি তার ভিতরেও প্রতিবাদের আলো, প্রতিরোধের সাহসকে অনুভব করেছেন ।
কাতারে কাতারে কত অচেনা শিবির, কুচকাওয়াজের ধ্বনি - শত্রুর আক্রমণ ও তাদের অস্ত্রের মহড়া। শত্রু কবলিত দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে ।
জীবনানন্দের নরম
শরীর ছুঁয়ে ঊর্ধ্বশ্বাস
বাতাস বয়েছে - জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এদেশের মানুষ ও প্রকৃতির কোমলতার প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। সেই কাব্যপ্রেরণা শহীদ কাদরীর চেতনায়ও গভীরভাবে ব্যাপ্ত। তাই তিনি জীবনানন্দের চোখ দিয়ে দেখা সৌন্দর্য-সমৃদ্ধ আবহমান রূপসী বাংলার স্মৃতিচারণ করেছেন এই কবিতায় ।
মগজের কুণ্ডলীকৃত
মেঘে পিস্তলের প্রোজ্জ্বল আদল - কবি মানব-মস্তিষ্কের গঠনকে কুণ্ডলী পাকানো মেঘের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একই সঙ্গে এই মেঘ বিপদ ও শঙ্কার চিহ্ন বহন করে । এই বিপদ থেকে মুক্ত হতে প্রয়োজন প্রতিরোধ – সশস্ত্র লড়াই। এই লড়াই চালিয়ে যেতে যত না শারীরিক শক্তির প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার মানসিক শক্তির। তাই কবির কল্পনায় মস্তিষ্ক নিজেই হয়ে ওঠে। অস্ত্র, পরিগ্রহ করে পিস্তলের আকার। এই বোধ ও চৈতন্যের অস্ত্রকে সঙ্গী করেই এদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে ।
পূর্ণিমা - যে তিথিতে চাঁদের ষোলকলা পূর্ণ হয় । পূর্ণিমার চাঁদের আলো বোঝাতে ।
উঠোন - আঙিনা। কবিতায় 'নিজস্ব উঠোন' বলতে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজের করে পাওয়া স্বদেশকে বোঝানো হয়েছে ।
কবিতাটি শহীদ কাদরীর ‘নির্বাচিত কবিতা' গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে । একাত্তরের যুদ্ধ-বাস্তবতাকে কবি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির ব্যতিক্রমী দ্যোতনায় উপস্থাপন করেছেন এই কবিতায়। আক্রান্ত স্বদেশ নিজেই এই কবিতায় এক সাহসী যোদ্ধা । সে প্রাকৃতিক কৌশলে তার সহযোদ্ধাদের যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে; শত্রুর বিরুদ্ধে গড়ে তোলে অলঙ্ঘ্যনীয় প্রতিরোধ। কবি এই সহযোদ্ধাদেরই একজন। তাই তিনি স্বদেশকে একটি আংটির মতো করে আপন কনিষ্ঠ আঙুলে ধারণ করেন; স্বদেশের সঙ্গে গড়ে তোলেন নিবিড় এক সম্পর্ক । কবিতায় উল্লেখিত “কনি” আঙুল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । প্রাচীন গ্রিসে হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে পাঁচ দেবতাকে বোঝানো হতো; যেমন : তর্জনী দিয়ে বোঝানো হতো দেবরাজ জিউসকে, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে বোঝানো হতো সমুদ্র দেবতা পসিডনকে । ঠিক একইভাবে গ্রিক যুদ্ধ দেবতা এরিসকে প্রতীকায়িত করে এই “কনি” আঙুল; যা কেবল লড়াই নয়, একই সঙ্গে নিরাপত্তা প্রদানেরও প্রতীক। আর এই ব্যঞ্জনাকেই কবি আলোচ্য কবিতায় ব্যবহার করেছেন । স্বদেশকে কবি এখানে আংটির সঙ্গে তুলনা করেছেন আর 'কনি আঙুল' দ্বারা প্রতীকায়িত এরিসের মতোই অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশ-মাতৃকার নিরাপত্তা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন । একই সঙ্গে, এই 'আংটি' শব্দবন্ধ দ্বারা উপমিত স্বদেশ হচ্ছে কবির অভিজ্ঞান তথা পরিচয়-চিহ্ন। কেননা, স্বদেশকে দিয়েই তো বিশ্বে আমাদের পরিচয় চিহ্নিত হয়। মাতৃভূমিকে নিয়ে কবির এই বহুমাত্রিক অনুভব ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে। যাকে তিনি তুলনা করেছেন আংটির সঙ্গে, পরে তাকেই আবার তুলনা করছেন জেব্রার সঙ্গে। প্রাণিজগতে জেব্রা শারীরিক গঠনে ও স্বভাবে অত্যন্ত স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত; সৌন্দর্য, সততা আর স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এদের দেহের সাদা-কালো ডোরাকাটা বৈপরীত্যের সম্মিলনকে নির্দেশ করে; ঠিক যেমন এদেশেও নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ অনায়াসে পরস্পরের সঙ্গে মিলে যেতে পারে। একই সঙ্গে জেব্রা অত্যন্ত সামাজিক এবং একের বিপদে অন্যের এগিয়ে আসার প্রবণতার কারণে এরা বিশেষভাবে খ্যাত । বাংলা ভূখণ্ডেও এই সামাজিক সম্প্রীতি দূরাতীত কাল থেকেই সুলভ। তাই কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে স্বদেশের সঙ্গে মিলিয়ে নেন জেব্রার ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বময়তাকে ।
এদেশে সামরিক আগ্রাসন, পাকিস্তানি শোষকদের নির্মম অত্যাচার, লাখো মানুষের হত্যা, নির্যাতন – এত সবকিছুর পরেও কবির মহিমান্বিত স্বদেশ অটল অচঞ্চল হয়ে জেগে থাকে। লাখো মৃত্যুর বেদনা এদেশের মানুষকে দমিয়ে ফেলতে পারেনি। পরাধীনতার শিকলে যারা বাঁধা পড়েছিল দীর্ঘদিন, তারাই মুক্তির বোধে উজ্জীবিত হয়েছে; মগজের অস্ত্রের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে যুদ্ধজয়ের আয়ুধ। মুক্তিসংগ্রামের এই পথে কবির কল্পনায় বাংলার নিসর্গও আবির্ভূত হয়েছে একজন সপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধার বেশে ।
মুক্তিযুদ্ধের এই অমর অভিব্যক্তি কেবল কবিতাটির বক্তব্যে নয়, এর আঙ্গিক সৌকর্যেও গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয় । তাই 'কনি আঙুল', 'জেব্রা', 'জীবনানন্দের কোমল শরীর', 'বিদ্রোহী পূর্ণিমা' প্রভৃতি শব্দবন্ধের আশ্রয়ে কবি প্রতীকের মালা গাঁথেন । আবার এরই সঙ্গে তিনি নান্দনিক চিত্রকল্পের ঋজু সমাহারকে সমন্বিত করেন। তাই `বাতাসে শুধু ঝলসে যাওয়া স্বজনের রক্তমাংসের ঘ্রাণ', 'মগজের কুণ্ডলীকৃত মেঘে পিস্তলের প্রোজ্জ্বল আদল', “আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠান পার হ'য়ে নিজেদের ঘরে'- এসব পঙ্ক্তি পাঠক হৃদয়ে ইন্দ্ৰিয়াতীত বোধকে উদ্দীপিত করে । এর মধ্য দিয়ে কবিতাটি হয়ে ওঠে বিশেষভাবে নান্দনিকতাঋদ্ধ । কবিতাটি অসমপর্ব বিশিষ্ট এবং অক্ষরবৃত্তের চালে গদ্যছন্দে রচিত।
এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই
আমরা এশিয়ার কৃষক
এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই
আমরা আফ্রিকার শ্রমিক
এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই
আমরা ইউরোপের শিশু
আমরা শান্তি চাই;
আমাদের সকলের সমবেত প্রার্থনা আজ – শান্তি ।
এই শান্তির জন্যে মিউনিখ শহরে তোলপাড় করেছি আমরা
এই শান্তির জন্যে ইতালির রাজপথে করেছি দীর্ঘ মিছিল
এই শান্তির জন্যে নিউইয়র্ক শহরে বিক্ষোভ করেছি অসংখ্য
মানুষ
এই শান্তির জন্যে আমরা আফ্রিকার শিশু
প্যালেস্টাইনের কিশোর আর নামিবিয়ার যুবক কতো বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি,
আবার এই শান্তির জন্যে বাংলার দুঃখিনী মায়ের চোখে
ঘুম নেই ।
সবুজ শস্যক্ষেত, সদ্যফোটা ফুল ও শিশুর
হাসির জন্যে
পৃথিবী জুড়ে আমরা চাই শাস্তিকল্যাণ । শাস্তি চাই যারা শিশুদের ভালোবাসি
শাস্তি চাই যারা রাজা গোলাপ ভালোবাসি:
শান্তি চাই যারা লুমুম্বা, আলেন্দে ও শেখ মুজিবের
নিষ্ঠুর মৃত্যুর জন্য কাঁদি
শান্তি চাই যারা পিকাসোর গোয়ের্নিকার কথা ভাবি
এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই—
শিশুদের পদধ্বনির মতো শান্তি
বকুল ঝরে পড়ার মতো শান্তি
রজনীগন্ধার খোলা পাপড়ির মতো শাস্তি ।
আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকির ব্যথিত আত্মা
আমরা শান্তি চাই;
আমরা ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদ
আমরা শান্তি চাই;
আমরা শোকাহত মায়ের চোখের জল
বোনের ক্রন্দন, স্ত্রীর শোকাশ্র
আমরা শান্তি চাই;
আমরা কবিতা ভালোবাসি
আমরা শান্তি চাই;
আমরা শিল্প ও জীবন ভালোবাসি
আমরা শান্তি চাই;
আমরা এখনো মানুষের হৃদয় ও মনুষ্যত্বে
সমান বিশ্বাসী
আমরা শান্তি চাই ।
[সংক্ষেপিত]
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি মহাদেব সাহা ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পৈতৃক বাড়ি পাবনা জেলার ধানঘড়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম গদাধর সাহা এবং মায়ের নাম বিরাজমোহিনী সাহা। কবির শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে বগুড়া এবং রাজশাহীতে । ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন ।
মহাদেব সাহার কবিতা মানবের সুখ ও দুঃখের এক চলমান উপাখ্যান । সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, রাজনীতি-মনস্কতা মহাদেব সাহাকে টেনে আনে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস', ‘মানব এসেছি কাছে', 'চাই বিষ অমরতা', 'ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস', 'কোথা প্রেম কোথা সে বিদ্রোহ', ‘বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ', ‘একবার নিজের কাছে যাই' প্রভৃতি । তিনি ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকসহ আরও বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ।
মিউনিখ - জার্মানির বায়ার্ন রাজ্যের রাজধানী। জার্মান ভাষায় শহরটির নামের উচ্চারণ ম্যুনশেন। শহরটি ইসার নদীর তীরে বেভারীয় আল্পসের উত্তরে অবস্থিত । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসময়ে হিটলারের বিরুদ্ধে এই শহরে ছাত্র ও শিক্ষকরা এক অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ।
নিউইয়র্ক - যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিউইয়র্ক রাজ্যের সবচেয়ে বেশি জন- অধ্যুষিত মহানগর। জাতিসংঘের সদর দপ্তর হওয়াতে এ মহানগর বিশ্ব মানবের মিলন কেন্দ্রে পরিণত।
প্যালেস্টাইন - আরবি উচ্চারণে ফিলিস্তিন । ভূমধ্যসাগর এবং জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল । ইসরাইলের সঙ্গে এখনও এই অঞ্চলের জনগণের যুদ্ধ চলছে।
নামিবিয়া - আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের একটি দেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার শাসনের বিরুদ্ধে প্রায় চব্বিশ বছরব্যাপী দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গেরিলা যুদ্ধের পর ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে দেশটি স্বাধীন হয় ।
লুমুম্বা
প্যাট্রিস এমেরি লুমুম্বা; জন্ম দোসরা জুলাই ১৯২৫, মৃত্যু ১৭ই জানুয়ারি ১৯৬১। আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা এবং দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা লাভের মাত্র বারো সপ্তাহ পরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি নিহত হন ।
আলেন্দে - সালভাদর গুইলার্মো আলেন্দে গোসেন্স জন্ম ২৬৩ জুন ১৯০৮ এবং মৃত্যু ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। চিলির বামপন্থি নেতা এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম মার্কসবাদী রাষ্ট্রপতি। দেশ পরিচালনার নীতিসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থানে বন্দি হন। বন্দি অবস্থাতেই তিনি তাঁর শেষ ভাষণ দেন এবং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে হত্যা করা হয়।
পিকাসো - পাবলো রুইজ ই পিকাসো জন্ম ২৫এ অক্টোবর ১৮৮১ এবং মৃত্যু ৮ই এপ্রিল ১৯৭৩। বিশ শতকের বিখ্যাত স্পেনীয় চিত্রশিল্পী। বিশ শতকের অন্যতম শিল্প-আন্দোলন কিউবিজমের অন্যতম প্রবক্তা। ওই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল আঁকা ছবিতে বিমূর্ততা সঞ্চার এবং ত্রিমাত্রিকতা যোজনা করা, যার সাহায্যে একটি ছবিকে বহু দৃষ্টিকোণে বিবেচনা করা যায় ।
গোর্নিকা - পিকাসোর একটি বিখ্যাত ছবি। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলাকালে উত্তর স্পেনের একটি ছোট শহর গোর্নিকায় জার্মান ও ইতালির মদদে বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় এই ছবিটি তিনি আঁকেন। ছবিটিতে যুদ্ধের মর্মান্তিকতা এবং সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা ও অসহায়ত্বকে তুলে ধরা হয়।
“শান্তির গান” কবিতাটি কবি মহাদেব সাহার 'ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস' (১৯৮৪) গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে । পৃথিবীব্যাপী মানুষের জন্য শান্তির অন্তহীন প্রত্যাশা নিয়ে কবি যে গান রচনা করে চলেন অবিরাম, তারই দ্যোতনা বহন করে আলোচ্য কবিতাটি । এ কবিতায় কবি ধাপে ধাপে তুলে ধরেছেন—কাদের জন্য এই জন্য, শান্তি, কেমন করে তারা শাস্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে, শান্তিকামী এই মানুষগুলোর মনস্তত্ত্বই বা কেমন। এক কথায় বলা যায় যে, কবির এই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা মূলত মেহনতি মানুষের জন্য, শিশুদের মনুষ্যত্ববোধে উদ্দীপ্ত সকলের জন্য । তাই কবি এশিয়ার কৃষক, আফ্রিকার শ্রমিক, ইউরোপের শিশু—সকলকে এই শাস্তি-পতাকার তলে সমবেত করতে চান । শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কবি এবং কবির মতো মানুষেরা লড়াই করেন; প্রতিবাদের ঝড় তোলেন মিউনিখ, নিউইয়র্কসহ ইতালির বিভিন্ন শহরের পথে পথে। কিন্তু শান্তি বিরোধীরাও থেমে থাকে না । তারা হয়ে ওঠে আরও হিংস্র, ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর। এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে, অশান্তির গর্জনকে থামিয়ে দিতে প্রয়োজন হয় সতর্ক প্রহরার । তাই যুগে যুগে আফ্রিকার শিশু, প্যালেস্টাইনের কিশোর, নামিবিয়ার যুবক এমনকি বাংলাদেশের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা নির্ঘুম রাত জেগে হয়ে ওঠে শান্তির প্রহরী । একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন 'একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করেছিল, তেমনি এই শান্তির সেনানীরা 'শস্যক্ষেত, সদ্যফোটা ফুল, শিশুর হাসির জন্যে' শান্তি চায়। এই শান্তির পক্ষের মানুষগুলোর মন হয় কোমল, হৃদয়জুড়ে থাকে অফুরান আবেগ। তাই তারা লুমুম্বা, আলেন্দে, শেখ মুজিবের নির্মম হত্যাকাণ্ডে অশ্রুসিক্ত হয়, পিকাসোর প্যের্নিকা তাদের আবেগাপ্লুত করে ।
কবিতাটি বিবৃতিধর্মী; বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কবি একের পর এক স্বভাবোক্তি করে চলেন । কেননা, কবি জানেন, প্রতিবাদের কথা, প্রত্যাশার কথা বলতে হয় সরাসরি স্পষ্টভাবে। তিনটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বলা যায়, অলংকারসমৃদ্ধ কবিতা রচনার প্রচল রীতি থেকে মহাদেব সাহা এই কবিতায় বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। যা তিনি বলতে চান তাতে কোনো আড়াল রাখার পক্ষে তিনি নন । কবি মানুষের দুঃখের কথা বেদনার কথা আশার কথা প্রত্যাশার কথা তুলে ধরার জন্য গদ্যের সহজ ভঙ্গি কবিতায় ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কবিতাটিকে নিবিড়ভাবে বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তুলতে তিনি ব্যবহার করেন অনেক ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ। পৃথিবীর চেনা ভূগোলকে তিনি কাব্যিক পেলবতায় পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন । আর এরই সঙ্গে কবি অন্তর্বয়ন ঘটান ‘বকুলের ঝরে পড়ার মতো শান্তি', 'রজনীগন্ধার খোলা পাপড়ির মতো শান্তি - এরকম উপমামণ্ডিত
নান্দনিক আবহসমৃদ্ধ পঙ্ক্তিমালা । এভাবে কবিতাটি বিষয়ে ও আঙ্গিকে বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে । কবিতাটি গদ্যছন্দের চাল অনুসরণ করে রচিত । অন্ত্যমিলবিহীন ছোটবড় পঙ্ক্তিতে কবিতাটির কাঠামো গড়ে উঠেছে ।
আরও দেখুন...